শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ঠেকাতে পারেনি দুজন অদম্য শিক্ষার্থীকে। গতকাল প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে তারা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। একজন পা দিয়ে লিখে অন্যজন ডান হাত অকার্যকর থাকায় বাম হাত দিয়ে লিখে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সীতাকুণ্ডের তরুণ রফিকুল ইসলাম রাব্বি। বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে দুর্ঘটনায় দুই হাত হারিয়েছিল। এবারের এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল পা দিয়ে লিখে।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড থেকে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, রাব্বি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে হাজি তোবারাক আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।
ভাটিয়ারী ইউনিয়নের বজলুর রহমানের ছেলে রফিকুল ইসলাম রাব্বি ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় স্কুল থেকে ভাটিয়ারী বাজারে ফুট ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে তার দুই হাত হারায়। এরপর অদম্য রাব্বি প্রথমে মুখ দিয়ে ও পরে পা দিয়ে লেখা আয়ত্ত করে।
রাব্বি বলে, ‘আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী। তবে মনোবল অটুট ছিল। মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় আমি ভালো ফলাফল করেছি। ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চাই।’
রাব্বির বাবা বজলুর রহমান বলেন, ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমার ছেলে কঠোর পরিশ্রম করেছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে।’
ভাটিয়ারী হাজি তোবারক আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য্য বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার পরও রাব্বি অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো ফলাফল করেছে। পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিয়েছে। বিত্তবানরা যেন তার পড়ালেখায় সহযোগিতা করে, সেটাই প্রত্যাশা।
পরীক্ষাকেন্দ্র ফৌজদারহাট খয়রাতি মিঞা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, তাকে নিয়মানুযায়ী ৩০ মিনিট সময় অতিরিক্ত দেওয়া হয়; কিন্তু বাড়তি সময় সে নেয়নি।
সীতাকুণ্ডের শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নুরুচ্ছাফা বলেন, ‘রাব্বিকে সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে আমরা মুখ দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিয়ে সাফল্য পেতে দেখেছি। সে পা দিয়ে লিখে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছে।’
অন্যদিকে, জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার হুজাইফা। তার ডান হাতের কুনুইয়ের নিচের অংশ নেই। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কিংবা দরিদ্রতা; কোনোটাই তাকে হার মানাতে পারেনি। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি শ্রেণিতেই মেধার পরিচয় দিয়েছে।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার অদম্য ইচ্ছা নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায় হুজাইফা মোল্লা।
হুজাইফা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ভানুরকান্দা গ্রামের কৃষক মনজুর রহমান ও শাহানা দম্পতির ছেলে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন প্রত্যেক শ্রেণিতেই প্রথম হয়েছে সে। এরপর সোনামুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম হয়ে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। পরে অষ্টম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হলেও নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি হুজাইফার চলার পথে কখনো কখনো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দরিদ্রতা। তবে সে প্রমাণ করতে চায়, ইচ্ছা থাকলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কিংবা দরিদ্রতা কোনোটিই বাধা নয়।
হুজাইফা বলেন, ‘জন্ম থেকেই আমার ডান হাত নেই। আমি বাম হাত দিয়ে সব কাজকর্ম করি। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যদিয়ে আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। বাম হাতে লিখে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমার ইচ্ছা বড় হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হবো। আমি প্রমাণ করে দিতে চাই, ইচ্ছা আর চেষ্টা থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই কখনো বাধা হতে পারে না।’
হুজাইফার বাবা মনজুর রহমান বলেন, ‘ছোট থেকে হুজাইফা পড়ালেখায় মেধাবী। তার ডান হাত না থাকলেও সংসারের সব কাজ করে পরিবারে সহযোগিতা করে আসছে। সে কখনো নিজেকে প্রতিবন্ধী কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম মনে করে না। তবে পরিবারে অভাব-অনটন থাকায় আমরা তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। তবে তার লক্ষ্য পূরণে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার ফলাফলে আমরা খুব খুশি হয়েছি।’
সোনামুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমান বলেন, ‘হুজাইফা আমার বিদ্যালয়ের অন্যতম মেধাবী শিক্ষার্থী। সে হার মানতে রাজি নয়। সব পরীক্ষায় বাম হাত দিয়ে লিখেই সে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। বিদ্যালয় থেকে তাকে উপবৃত্তিসহ সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সে অনেক ভালো পর্যায়ে যাবে বলে মনে করি।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘হুজাইফাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আর্থিক ভাতা করে দেওয়া হয়েছে। বাম হাত দিয়ে লিখে জিপিএ-৫ পাওয়ায় অন্য প্রতিবন্ধীরাও তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে বলে মনে করি। আমরা সব সময় তার পাশে আছি।’
Collected From DainikBangla