পেশাগত জীবন গঠনের সব থেকে সংবেদনশীল পর্যায়টি হচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউ। যেখানে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ওপর নির্ভর করে পুরো ক্যারিয়ার, বিশেষ করে চাকরিটি যদি হয় খুব প্রয়োজনীয় অথবা বহু প্রত্যাশিত। নিয়োগকর্তার সঙ্গে এই আলাপচারিতায় প্রতিটি বাক্য তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে দেয় চাকরি পাওয়ার মাইলফলক।
এই আলাপের শেষ পর্বে থাকে বেতন–সম্পর্কিত কথোপকথন, যে মুহূর্তটি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আরও উত্তেজনার। প্রত্যাশিত বেতন নিয়ে কথা বলার এই ছোট্ট পর্বটি কীভাবে সফলভাবে সম্পন্ন করা যায়, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
প্রত্যাশিত বেতন বলতে আসলে কী বোঝায়
কোনো সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য সম্মানী হিসেবে নিয়োগর্কতার কাছে প্রার্থীর যে পরিমাণ অর্থের দাবি থাকে, সেটিই প্রত্যাশিত বেতন নামে অভিহিত। কাজের ধরন ও ক্ষেত্র, দেশ, ও সময়ের ভিত্তিতে এই সম্মানী পরিবর্তিত হয়। আর প্রত্যাশার সঙ্গে মৌলিকভাবে জড়িয়ে থাকে প্রার্থীর দক্ষতা, যার পরিপূরকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় অভিজ্ঞতা। এর সঙ্গে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে কাজটির চাহিদা, উপলব্ধতা এবং দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা।
এসব উপাদানের সাপেক্ষে যে পরিমাণ অর্থ দাবি করা হচ্ছে, প্রার্থী আসলেই তার প্রাপ্য কি না, তা প্রমাণ করা জরুরি। আর তারই যাচাই-বাছাই চলে চাকরির ইন্টারভিউতে। বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রার্থীর ঐচ্ছিক বিষয় হলেও অঙ্কটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথাযথ গবেষণার প্রয়োজন। নতুবা খুব কম দাবি করার ফলে প্রার্থী সঠিক আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। শুধু তাই নয়, এটি দীর্ঘ মেয়াদে তাঁর ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং একই সঙ্গে সেই কাজের বাজার নষ্ট করে। অন্যদিকে খুব বেশি দাবি করার মাধ্যমে চাকরির সুযোগটাই হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
কীভাবে প্রত্যাশিত বেতন নির্ধারণ করবেন
আত্মমূল্যায়ন: নিজের বাজার মূল্যটা ঠিক কত, তা বুঝতে হলে নিজেকে একটি পণ্য বা সেবা হিসেবে চিন্তা করতে হবে। একটি পণ্য চূড়ান্তভাবে বিক্রিযোগ্য হওয়ার পূর্বে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময় তার যাবতীয় খরচের সঙ্গে লাভের পরিমাণ যোগ করে তারপর ঠিক পণ্যের দাম। একজন ব্যক্তির পারদর্শিতার মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারটিও ঠিক একই। এখানে যাচাই করতে হয় একটি কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেতে কতটা শ্রম এবং সময় দেওয়া হচ্ছে। শারীরিক শ্রম অপেক্ষা মানসিক শ্রমের মূল্য বেশি।
অপেক্ষাকৃত কম রসদে তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে কাজটি সম্পন্ন করা। মূলত এর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে কোনো কর্মচারী বা কর্মকর্তার বাজারমূল্য। এ মূল্য যাচাইয়ের জন্য প্রার্থীকে প্রথমে দেখতে হবে বাজারে তার পারদর্শিতার চাহিদা কতটুকু। এই নিরীক্ষায় উতরে গেলে তারপরই আসবে দক্ষতার বিষয়টি। কাজের ইন্ডাস্ট্রিভেদে এই বিষয়টিকে বিশেষায়িত করে উচ্চশিক্ষা, পেশাগত ট্রেনিং এবং সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা। ব্যবহারিক বা প্রযুক্তিগত কাজগুলোতে প্রায় ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা গুরুত্ব পায়। আবার যে পারদর্শিতাগুলো খুব কম দেখা যায়, কিন্তু বাজারে চাহিদা প্রচুর, এগুলোর সম্মানী নিলামের মতো বাড়তে থাকে।
নেটওয়ার্কিং
বেতন কত হওয়া উচিত, তা জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো একই ইন্ডাস্ট্রির লোকদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করা। ক্যারিয়ারের শুরুতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র এবং শিক্ষকেরা এই নেটওয়ার্কিংয়ে ব্যাপক অবদান রাখেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন পদের বেতনের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়।
স্বভাবতই তথ্য সংগ্রহের জন্য এটি খুব স্বল্পমেয়াদি উপায় নয়, কেননা বেতন নিয়ে কথা বলতে কেউই প্রস্তুত থাকেন না। দীর্ঘদিন সম্পর্কের সুবাদে এ রকম তথ্য পাওয়া সম্ভব। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিন থেকেই বিভিন্ন ক্লাব, সিনিয়র ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্য অর্জনের চেষ্টা শুরু করতে হবে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপ ও ফোরামের দৌলতে নেটওয়ার্কিং অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।
জীবনযাত্রার খরচ বিবেচনায় রাখা
বেতন এমন হওয়া উচিত, যেন তা অবশ্যই জীবনযাত্রার আবশ্যক ব্যয়গুলোকে পরিপূর্ণভাবে সামাল দিতে পারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল, খাবার, চিকিৎসা ও যাতায়াত খরচ। বিবাহিতদের ক্ষেত্রে যুক্ত হবে শিশুসহ পরিবারের আনুষঙ্গিক খরচ। নিদেনপক্ষে এই খরচাদি পূরণ না হলে প্রতি মাসেই ঋণের দুশ্চিন্তা থাকবে। ফলে পরবর্তী সময়ে চাকরিতে পূর্ণ মনোনিবেশ এবং দক্ষতার যথাযথ ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। উপরন্তু জীবনধারণ উন্নত করার লক্ষ্যে ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়টিও বিবেচনা করা জরুরি।
চাহিদার সপক্ষে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য প্রদান
প্রস্তাবিত বেতনটি যৌক্তিক হওয়া আবশ্যক। আর এই যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য প্রয়োজন প্রাসঙ্গিক এবং সঠিক তথ্য। ধারণাগত দৃষ্টিকোণ থেকে উপযোগী নয়, তথ্যগুলো হতে হবে স্পষ্ট এবং পরিমাপযোগ্য। নির্দিষ্ট এ কাজের মূল্যের যথার্থতা প্রতিষ্ঠার পর প্রার্থীকে প্রমাণ করতে হবে যে কেন তিনি এই সম্মানী পাওয়ার যোগ্য। এখানে দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা প্রদর্শনের সময়েও খেয়াল রাখতে হবে, যেন তা দৃষ্টিগোচর এবং পরিমাপযোগ্য হয়। এর জন্য সাক্ষাৎকারের আগেই কোম্পানি ও সেই নির্দিষ্ট পদটি নিয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন।
কোম্পানি প্রদত্ত সুবিধা নিয়ে আলোচনা
চাকরির সাক্ষাৎকারের সময় আর্থিক দিকের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সুবিধার প্রতিও মনোনিবেশ দেওয়া উচিত। বেতনভুক্ত ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা, উৎসব ও পারফরম্যান্সে বোনাস এবং যাতায়াত সুবিধা যেকোনো চাকরির নির্ভরযোগ্যতার মাপকাঠি। এমনকি এই সুবিধাগুলোর উপযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক মূল্য থেকেও বেশি হয়। এ ছাড়া কাজের সময়সূচিতে নমনীয়তা এবং দেশে ও দেশের বাইরে ভ্রমণের সুযোগ বেশ চিত্তাকর্ষক। তাই কাঙ্ক্ষিত বেতনের প্রস্তাবে নিয়োগকর্তার রাজি না হওয়া মানেই সুযোগ হারানো নয়, যদি এই সুবিধাগুলো থাকে।
আত্মবিশ্বাস ও বিনয়ের মাঝে সমতা বিধান
চাকরি মূলত কোনো দয়াদাক্ষিণ্য নয়। এখানে পারদর্শিতার বিনিময়ে প্রাপ্যের দাবি রাখা হচ্ছে। সাক্ষাৎকারের সময় এই দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রত্যেক প্রার্থীকেই লালন করা উচিত। এমনকি নিয়োগকর্তা প্রার্থীর সর্বনিম্ন চাহিদা পূরণে অসমর্থ হলে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যানের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে প্রার্থীকে। নিয়োগকর্তার প্রস্তাবিত বেতন নিদেনপক্ষে প্রার্থীর জীবনযাত্রার ন্যূনতম খরচ সংকুলান হতে হবে। অন্যথায় পরে নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচসংক্রান্ত নানা দুশ্চিন্তায় প্রার্থীর কাজের গুণগত মান বজায় থাকবে না। এতে করে নিয়োগকর্তা ও প্রার্থী উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
উপরন্তু দর–কষাকষির সময় প্রার্থীকে এ–ও খেয়াল রাখতে হবে, তার আচরণ যেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ হয়ে না যায়। আবার মাত্রাতিরিক্ত বিনয় অপেশাদারত্বের লক্ষণ। তাই আত্মবিশ্বাস ও বিনয়—এ দুইয়ের মাঝে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আলাপ চালিয়ে যেতে হবে।
কাঙ্ক্ষিত বেতন নিয়ে কথা বলার সময় যে ভুলগুলো এড়াতে হবে
জবাবের শুরুতেই একবাক্যে বেতনের কথা জানিয়ে দেওয়া
‘এই পদের জন্য কত বেতন আশা করছেন?’—এমন প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সংখ্যাটি বলে ফেলা উচিত নয়। বরং সংখ্যাটির যথার্থতা আরও ভালোভাবে যাচাইয়ের জন্য কাজের পরিমাণ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। সাক্ষাৎকারের এই পর্বে প্রার্থীর মূল উদ্দেশ্য থাকতে হবে এই পদের জন্য নিয়োগকর্তার বাজেট সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। তাই নিয়োগকর্তার মুখ থেকেই বেতনের সংখ্যাটি প্রকাশিত হওয়া উত্তম। এ ছাড়া কাজের খুঁটিনাটি ব্যাপারে খতিয়ে দেখাটা প্রার্থীর ব্যাপারে নিয়োগকর্তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। তাঁরা বুঝতে পারেন যে প্রার্থী কাজের ব্যাপারে বেশ সচেতন।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ ছাড়াই আলাপ করা
কাজের সম্মানী নিয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া উচিত বিশ্লেষণধর্মী। ঘুরেফিরে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি একঘেয়ে পরিবেশের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া যুক্তি ছাড়া শুধু ধারণাগত দিক থেকে প্রত্যুত্তরে সাক্ষাৎকার দ্রুত সমাপনীর দিকে এগিয়ে যায়। তাই কাজকে ক্ষুদ্র স্তরে ভাগ করে ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন অঙ্গনে সেগুলোর মূল্যের ভিন্নতা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সময় নিয়োগকর্তাও তাঁর জানা বিষয়গুলো শেয়ার করবেন। এতে করে আলোচনা এগিয়ে চলবে। সেই সঙ্গে নিয়োগকর্তা প্রার্থীর পেশাদারত্বের ব্যাপারে ধারণা পাবেন।
দক্ষতার পরিবর্তে মৌলিক প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রার্থীরা তাঁদের প্রস্তাবিত বেতনের ন্যায্যতা দিতে জীবনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এভাবে আবেগের বশবর্তী হওয়া একটি নেতিবাচক ও অপেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে বেতনের ন্যায্যতা নিরূপণের চাবিকাঠি হওয়া উচিত কাজের দক্ষতা। আর কীভাবে এই দক্ষতা প্রয়োগ করা হবে, তা যুক্তি দিয়ে বোঝানো দর–কষাকষির উৎকৃষ্ট উপায়।
চাকরির ইন্টারভিউতে কাঙ্ক্ষিত বেতন নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোনিবেশ করা জরুরি। এর কার্যকারিতার অর্ধেকের বেশি অংশ নির্ভর করে ইন্টারভিউয়ের আগের কাজগুলোতে। নিজের বাজারমূল্য এবং নিয়োগকর্তাকে নিয়ে যত বেশি গবেষণা করা যাবে, সাক্ষাৎকারের সময় বেতনের প্রস্তাবনাকেও ততটাই ন্যায্যতা দেওয়া সম্ভব হবে। সর্বোপরি, প্রাসঙ্গিকতা, পরিমিতি বোধ এবং বিনয় ও আত্মবিশ্বাসের মাঝে সমতা বিধান দর–কষাকষির সর্বোত্তম উপায়।
Collected From prothomalo