আমি আমার কর্মজীবনের শুরুতে বেশ কিছু বছর বিশুদ্ধভাবে (একক অর্থে) কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করেছি। এই কথাটি বলবার একটি তাৎপর্য আছে। হয়তো লেখার ভিতরে গেলে আপনি সেটা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবেন। তবু বলি। বাংলাদেশে বিশেষায়িত ও মৌলিক লেখ্যবস্তুর (কনটেন্ট) খুব আক্রা (দুস্প্রাপ্যতা) আছে। তারপরেও, কেউ দু’কলম লিখলে অন্যরা, বিশেষত বড় বড় মানুষেরা সেটাতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার পরিবর্তে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করেন। নানাভাবে সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বন্ধ করার চেষ্টা করেন। এমনকি, লেখক ওই বিষয় নিয়ে লেখার অধিকারবোধ (ম্যান্ডেট) রাখেন কিনা, অন্য মাঠে (ফিল্ডে) কাজ করে অন্যের বিষয় নিয়ে কেন কথা বলা-তা নিয়েও প্রশ্ন করেন। তাই বললাম, বক্ষমান বিষয় নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার আছে। লেখাটি লিখতে যাদের সহায়তা পেয়েছি, যারা মন্তব্যের আকারে নানা পরামর্শ বা চাহিদা জানিয়েছিলেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশে কোনো ভাল কাজ করতে সহায়তা প্রাপ্তি এক দুস্প্রাপ্য বস্তু। লেখাটিতে কারিগরী বা তথ্যগত বিভ্রাট থাকতে পারে। সেগুলোকে গঠনমূলক দৃষ্টিতে দেখে ধরিয়ে দিন। লেখাটিতে আপনারা গভীর কারিগরী তথ্য পাবেন না। সেই অর্থে লেখাটির তাত্বিক গুরুত্ব কম। লেখাটিতে প্রথমবারের মতো একটি বিষয় ইচ্ছা করে করেছি। তা হল, প্রায় শতভাগ বাংলা শব্দ ব্যবহার। তবে অভ্যস্ততার জন্য বন্ধনিতে (ব্রাকেটে) সংশ্লিষ্ট ইংরেজি শব্দটি দিয়েছি। লেখাটি বিশাল আয়তনের হওয়ায় তিনটি পর্বে দিচ্ছি, তবে একই দিনে তিন পর্ব অবমুক্ত করছি। যাতে কেউ যদি আগ্রহী হন, তবে একই সময়ে পড়তে পারেন। লেখাটিকে আপনি ভাগ (শেয়ার) করতে পারেন, তবে অবশ্যই মূল লেখকের নাম, পরিচয়সহ। আমাদের একটি স্বভাব হল, একটি লেখা পড়েই সেটিকে কপি করে নিজের দেয়ালে “সংগৃহিত” লিখে আবার দেয়া। অথচ তিনি জানেন, মূল লেখক কে। এই কাজটি না করাই সামাজিক ভব্যতা। লেখা চুরির মতো তুচ্ছ কাজ বোধহয় আজকাল আর কেউ করেন না।
অনেকবারই বেশ কিছু মানুষ আমাকে বলেছিলেন, কমপ্লায়েন্স বিষয়টা নিয়ে কিছু লিখতে। যদিও বিষয় ভিত্তিক লেখা দেবার মতো বড় লেখক আমি নই। তাছাড়া আমি বর্তমানে বিশেষায়িতভাবে কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করিও না। মানে হল, আমাকে বাংলাদেশে বিদ্যমান কয়েক গন্ডা (ফেসবুক ভিত্তিক) কমপ্লায়েন্স দলের (গ্রূপের) সদস্য করার আগাপাশতলা কোনো উপায় নেই। তার উপর, আমি মনে করি না, কমপ্লায়েন্সকে কোনো একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে বা ঘরানায় আবদ্ধ করে ব্যাখ্যা করা যায়। কমপ্লায়েন্স অনেকগুলো মাত্রা (ডাইমেনশন অর্থে) নিয়ে কাজ করে। সেটি হতে পারে, আইনের যথাযথ প্রতিফলন, সেটি হতে পারে ক্রেতার (ব্র্যান্ড) আচরনবিধির প্রতিফলন, সেটি হতে পারে সামাজিক নৈতিকতার (ইথিকস) প্রতিফলন, আবার সেটি হতে পারে বানিজ্য নৈতিকতার প্রতিফলন। তাছাড়া এককভাবে কমপ্লায়েন্স নিয়ে লেখাও মুশকীল। কারন কমপ্লায়েন্স কোনো একক বিষয় নয়। এটি মূলত একজন ব্যক্তি হতে শুরু করে একটি প্রতিষ্ঠান, এমনকি একটি দেশকে নিয়েও কথা বলার প্রেক্ষিত দাবী করে। তবে, লেখার স্বার্থে এই লেখায় আমি মূলত তৈরী পোষাক কারখানায় বিভিন্নমূখী কমপ্লায়েন্স নিয়ে কিছু কথা বলব।
শুরুতেই স্বভাবসূলভভাবে একটি গল্প বলি। বাংলাদেশের কমপ্লায়েন্স পেশাজীবিদের মধ্যে বোধহয় কেউ এমন নেই, এই আত্মপ্রবঞ্চনামূলক (স্যাটায়ার) গল্পটি জানেন না। গল্পটির মূল রচয়িতা কে-তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে যেই হোন, তিনি খুব বুদ্ধিমত্তাপূর্ন একটি গল্প লিখে গেছেন। গল্পটির অনেকগুলো সংস্করন অন্তর্জালে (ইন্টারনেট) পাওয়া যায়। আমি আমার মতো করে এটিকে কিঞ্চিত রূপান্তর করে নিচ্ছি।
অজ-পাড়াগাঁয়ে একটি সম্পূর্ন নতুন (ব্র্যান্ড নিউ) ঝা চকচকে BMW দাড়া করিয়ে (পার্ক করে) একজন চোস্ত যুবক নেমেই এক রাখালকে ডাকলো।
অভিজাত যুবক: এই, ছাগলের বহর কি তোমার?
রাখাল: হ, সাব।
অভিজাত যুবক: তোমার এখানে কতগুলো ছাগল আছে আমি যদি তা বলে দিতে পারি, তার বিনিময়ে কি তুমি আমাকে একটি ছাগল গিফ্ট করবে?
রাখাল: রাজি আছি।
গাড়ি মালিক অভিজাত যুবক তখন Apple Laptop এ NASA page খুলে GPS satellite-এর মাধ্যমে জায়গাটা Locate করে, ক্রেডিট কার্ড নম্বর দিলো। তারপর NASA satellite দিয়ে মাঠটা ও ছাগলের পাল scan করে জার্মানির হামবুর্গে পাঠাল। এরপর সে ডাটাটা OBDC কানেক্টের মাধ্যমে MS-SQL- এ নিয়ে তার Iphone-৭প্লাস এ open করল। এতে তার $২০৫০ চার্জ হলো। কয়েক মিনিট পর সে result পেল।
অভিজাত যুবক: "এখানে ৩৩ টা ছাগল আর বাচ্চা আছে"
রাখাল: হাচা কইচেন।
অভিজাত যুবক: ”তাহলে এইটা আমার গিফট্” (বলেই একটি ছাগলের বাচ্চা তুলে নিলো)।
এরপর সে স্কাইপের মাধ্যমে তার মাকে বলল, “Mom, আমি হাই টেক apply করে একটা গিফট্ পেয়েছি।
রাখাল: আপনার পরিচয় তো আমাকে বলেননি। আমিও জানতে চাইনি। এখন যদি আমি বলতে পারি, আপনি কে ও কী করেন, তাহলে পুরস্কারের ছাগলটা আমাকে ফিরিয়ে দেবেন?
অভিজাত যুবক: Sure।
রাখাল: আপনি আসলে একজন অডিটর।
অভিজাত যুবক: Yes, কেমনে জানলে?
রাখাল: অনাহুত ঢুকে পড়ে, কাস্টমারের চাহিদা ছাড়াই, বেহুদাই সময় নষ্ট করে, অযথা জটিলতা সৃষ্টি করে, যেই তথ্য এমনিতেই পাওয়া যেত, সেটা হাজার হাজার টাকা খরচ করে গুনলেন কয়টা ছাগল। এইগুলো ছাগল না, এইগুলো ভেড়া। আর আপনার হাতে ওটা ছাগল না, কুকুরের বাচ্চা, ওটা ভেড়া তাড়ানোর কাজ করে। কমপ্লায়েন্স নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের দৃষ্টিতে নিরীক্ষা (অডিট) ও নিরীক্ষকদের (অডিটরদের) নিয়ে চিন্তার জগতটি নিয়ে রচিত এই গল্পটির সাথে খু্ব মিলে যায়। [আমার সুহুদদের তালিকায় থাকা নিরীক্ষকগণ (অডিটরগণ) ব্যাপারকে স্রেফ মজা হিসেবে নিলেই ভাল।]
বাংলাদেশে ব্যক্তিখাতে কাজ করা যেকোনো পেশাজীবিদের নানারকম নৈরাশ্যর (ফ্রাসট্রেশন) মধ্যে অন্যতম একটা হল, প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া। এই ক্ষেত্রে বোধহয় সবচেয়ে এগিয়ে আছে কমপ্লায়েন্স বিভাগ। কারন তারা বরেরও মাসি, কণেরও পিসি। মালিক তাদের মনে করে খরচ ও অপচয়ের খাত এবং ভেজাল লাগানোর ওস্তাদ। ওদিকে ক্রেতার প্রতিনিধিগন তাদের মরিচ পেষা করেন কোনোরকম আইনভঙ্গ বা নন-কমপ্লায়েন্ট হবার প্রমাণ পেলে। তেমনটা ঘটলে, মানে ক্রেতার নিরীক্ষকগণ (অডিটর) কোনো বোলচাল ধরতে পারলে কারখানার বারটা বাজে। ক্রয়াদেশ বাতিলসহ কারখানা লাল চিহ্নিত (কালো তালিকাভূক্ত) হবারও নজির আছে। তেমন হলে আবার মালিক কমপ্লায়েন্সের লোকদের ফাঁসি দেবার যোগাড় করেন। এই কয়েকদিন আগেও একটি প্রতিষ্ঠানের ‘হেড অব এইচআর-কমপ্লায়েন্স’ যিনি এই ক্ষেত্রে (সেক্টরে) অত্যন্ত সম্মানিত ও জেষ্ঠ্য, তাকে মালিক নিরীক্ষা (অডিট) ফেল করায় পত্রপাঠ বিদায় করেছেন। আরএমজি ক্ষেত্রের (সেক্টরের) মাঠপর্যায়ে যারা কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করেন, তাদের যে কী ভীষন নৈরাশ্য (ফ্রাসট্রেশন অর্থে) নিয়ে কাজ করতে হয়, তা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। একটা সময় ছিল, যখন কমপ্লায়েন্স বিভাগে কাজ করা লোকদের কারখানার লোকেরা পাগল ঠাউরতো। তাদেরকে মনে করা হত অন্য গ্রহ থেকে আসা এলিয়েন। অবশ্য এর কারনও ছিল। তখন পর্যন্ত আমাদের আরএমজি ক্ষেত্র মানসিক, তাত্ত্বিকভাবে আধুনিকমনা হয়ে ওঠেনি। তাই, কমপ্লায়েন্সের কর্মীরা যেটাই নতুন করে করতে বলতেন, বাদবাকি লোকেরা সেটাতেই হাস্য পরিহাস করতেন। আমার মনে আছে, আমি যখন প্রথম প্রথম গার্মেন্টস ক্ষেত্রে কাজ শুরু করি, সন্ধ্যা ৭ টা বাজলে আমি বাড়ির পথ ধরতে ব্যাগ গোছাতাম। আমার ১৫ আনা সহকর্মী আমাকে নিয়ে হাসতেন। পরিহাস করতেন। বকতেনও- “ওই মিয়া, তুমি গার্মেন্টসে আসছ কেন, সরকারী চাকরী করতা। গার্মেন্টস কোনোদিন ১০ টার আগে ছুটি হয়?” হ্যা হয়, অবশ্যই হয়। আমি ওই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীনই সন্ধ্যা ৭ টার ভিতর কারখানা আর ৬ টার ভিতরে প্রধান কার্যালয় ছুটির সংস্কৃতি বাস্তবায়ন হয়েছে। আমি তখন ওনাদের নিয়ে হাসতাম।
কমপ্লায়েন্স কী?
কমপ্লায়েন্স বলতে আপনি একটি বিভাগকে বুঝতে পারেন, একটি কাজকে বুঝতে পারেন, একটি মানদন্ডকে বুঝতে পারেন, কিংবা একটি ‘গালি’কেও বুঝতে পারেন। [হা হা হা, গার্মেন্টস ক্ষেত্রে (সেক্টরে) কমপ্লায়েন্সকে রীতিমতো অপমানজনকভাবে সম্বোধনেরও নজির আছে।]
আমার মতে, কমপ্লায়েন্স মানে, সহজ কথায় ‘কমপ্লাই’ করা। একজন ব্যক্তি হতে সমাজ হয়ে রাষ্ট্র, একজন কর্মী হতে শুরু করে একটি গোটা কর্মীবাহিনী, একটি ডেস্ক হতে শুরু করে একটি গোটা প্রতিষ্ঠান, তার বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান, সুবিধাভোগী দল, কাউন্টারপার্ট-সবারই জন্য একটি প্রমিত বা কাঙ্খিত মানের সমষ্টি এবং তার যথাযথ প্রতিপালন হল কমপ্লায়েন্স। যেই মানদন্ডের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকবে ওই সকল এককের সামাজিক, কর্পোরেট, সাংস্কৃতিক, বানিজ্যিক, আর্থিক, ভৌত, নীতিগত, পদ্ধতিগত, নিরাপত্তাজনিত, পরিবেশগত ও আইনগত কাঙ্খিত মানের আনু্ষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, সম্মতি, প্রতিপালন, বাস্তবায়ন, টেকসইকরণ ও স্বচ্ছতা রক্ষণ, তথা প্রতিবেদন প্রদান । সব ক্ষেত্র ও প্রতিষ্ঠানের জন্য কমপ্লায়েন্স রক্ষা করা বাধ্যতামূলক হলেও সাধারনত বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের কমপ্লায়েন্স বিষয়টিই বেশি আলোচনায় আসে। কমপ্লায়েন্সের আলোচনায় সিংহভাগ জুড়েই থাকে গার্মেন্টস শিল্পের নানামুখী কমপ্লায়েন্স।
দেশের বৃহত্তম শিল্প ক্ষেত্রের জন্য কমপ্লায়েন্স বলতে আমরা যেই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রাখি, তা হল, একটি উৎপাদনমুখী তৈরী পোশাক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, নির্মান, উৎপাদন, বিপনন, বিক্রয়, পরিচালন, নীতি প্রণয়ন, বানিজ্য সম্পর্ক, সামাজিকীকরন-অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দিক যেন এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রীয় আইন, সংশ্লিষ্ট ক্রেতার আচরনবিধি (কোড অব কনডাক্ট) ও নৈতিকতার মানদন্ড মেনে ব্যবসা করে, সেটাই হল কমপ্লায়েন্স, যা আসলে হবে To comply with DOs & DON'Ts"। এক কথায়, “যা করণীয়, তার পালন ও নজরদারী। আর সেই নজরদারীর কাজটি (এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরামর্শক/বিশেষজ্ঞের ভূমিকাও) পালন করে কমপ্লায়েন্স বিভাগ। কিছু কাজ এই বিভাগ সরাসরি নিজেরা করে থাকে, আর বাকিটা হল, অন্যান্য বিভাগ যাতে একইভাবে নিজের করণীয় ও পালনীয় নীতি মেনে চলে, তার উপর নজরদারী ও পরামর্শকের ভূমিকা পালন।
কমপ্লায়েন্স যদিও এখন আর শুধু গার্মেন্টস শিল্পে সীমাবদ্ধ নেই। তা এখন নানামুখী প্রতিষ্ঠান ও শিল্পেই ছড়িয়েছে। আসলে, হে মার্কেটে শ্রমিক আন্দোলন, যার থেকে মে দিবসের সূচনা, আমি মনে করি, সেই আন্দোলনই কমপ্লায়েন্সের জন্মদাতা। ন্যায্য মজুরী ও যুক্তিযুক্ত মানবিক কর্মসময়ের দাবীতে জেগে ওঠা সেই আন্দোলন, সেই শ্রমদাবী আজকে ২০১৯ সালে এসে অনেক শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়েছে। মোটা দাগে আজকের কমপ্লায়েন্স মানে-
শ্রম সম্পর্কের কমপ্লায়েন্স
শ্রম সময়ের কমপ্লায়েন্স
নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থার কমপ্লায়েন্স
স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশের কমপ্লায়েন্স
পরিবেশ ও প্রতিবেশের কমপ্লায়েন্স
বানিজ্য নীতি ও ব্যবসার নৈতিকতার কমপ্লায়েন্স
আর্থিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কমপ্লায়েন্স
ঝুঁকি ও হুমকী মোকাবেলার কমপ্লায়েন্স
ব্যক্তিগত, দলগত, লিঙ্গভিত্তিক, ভৌগলিক, উৎসগত শ্রম স্বীকৃতি ও অবৈষম্যের কমপ্লায়েন্স
শ্রম অধিকার ও শ্রম স্বাধীনতার কমপ্লায়েন্স, ইত্যাদি
-কমপ্লায়েন্সের ধারনার সূত্রপাত:-
আগেই বলেছি, শিকাগোর হে মার্কেটে ন্যায্য শ্রমঘন্টা ও শ্রমমূল্যের দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলন এবং সেখানে গুলি চালিয়ে শ্রমিক হত্যার প্রেক্ষিতে পরবর্তিতে বিশ্বব্যাপী ৮ ঘন্টা/প্রতিদিন হিসেবে শ্রমসময় নির্ধারিত হয়। আমার কাছে মনে হয়, সেটিই ছিল উৎপাদনমুখী শিল্পে কমপ্লায়েন্স মেনে চলার প্রথম ধাক্কা। দিন দিন সেই কমপ্লায়েন্স দাবী আরো বিস্তৃত ক্ষেত্রে শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে আশির দশকে রপ্তানিমুখী তৈরী পোষাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় দেশ গার্মেন্টস, রিয়াজ গার্মেন্টস এর হাত ধরে। তৎকালীন সময়ে খুবই সীমিত পরিসরে, খুব সামান্য পরিমানে তৈরী পোষাক রপ্তানি হত বিদেশে। নব্বইয়ের দশকে গার্মেন্টস শিল্প ফুলে ফেঁপে ওঠে। এটি একটি পরিপূর্ন ও আনুষ্ঠানিক শিল্প সেক্টরে রূপ নেয়। নানা কারনেই গার্মেন্টস কারখানার সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। অবশ্য সেই শুরু থেকে আজও এই শিল্পটি মূলত এসেম্বলিং ও প্রসেসিং শিল্প (কাটিং, স্টিচিং, ওয়াশিং, ফিনিশিং-অর্থাৎ বৃহৎ আঙ্গিকের টেইলরিং) হিসেবেই বড় হয়েছে। সেই শুরুর সময়ে বাংলাদেশে এমনিতেই নানামুখী চ্যালেঞ্জের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। যেকোনো প্রকারে কর্মসংস্থান, রপ্তানী আয় সৃষ্টি, পূঁজির প্রবাহ সৃষ্টি, বিনিয়োগ সৃষ্টি-এই ছিল মূল লক্ষ্য। ফলে গার্মেন্টস কারখানা ও সামগ্রিক শিল্পটি গড়ে উঠতে থাকে অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিতভাবে। এর ফলে শিল্পটির সার্বিক কাঠামো, অবকাঠামো, স্বরূপ, সংস্কৃতি, নীতি, পরিবেশ, কর্মপরিবেশ, শিল্প সম্পর্ক-সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়, প্রয়োজনভিত্তিক ও সহজাত ভিত্তিতে গড়ে উঠতে থাকে। যতটা না পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্পটির সার্বিক বৃদ্ধি হয়েছে, তার চেয়ে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ, বাস্তবতার চাপ, বায়ারদের চাপ, অবস্থার ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তন-এভাবেই এগোতে থাকে গার্মেন্টস। এতে করে গার্মেন্টস কারখানা একদিকে যেমন নিজের আপন গতিতেই আবাসিক বাসাবাড়ি, আধা কমার্শিয়াল আধা শিল্প এলাকায় বিস্তৃত হতে থাকে, আরেকদিকে এই শিল্পের সার্বিক কর্মপরিবেশ ও শিল্প সম্পর্কও আপন গতিতে নির্মীত হতে থাকে। যার ভিতরে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদন্ড মেনে সার্বিক কমপ্লায়েন্সের উন্নতি ঠিক ততটা প্রাধান্য পায়নি।
শিল্পটি যখন মোটামুটি দাড়িয়ে গেল এবং একটি সম্ভাবনাময় ও স্বীকৃত শিল্প হিসেবে স্থান করে নিল, তখন সরকারী, বেসরকারী, বিদেশী ও বায়ারদের নজর পরে এর শ্রমমান, শ্রমসম্পর্ক, আইনি দিক, নিরাপত্তা এসবের উন্নয়নে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকেই গার্মেন্টসে প্রথাগত কমপ্লায়েন্স চাহিদার উন্মেষ ঘটে। স্রেফ পোষাক তৈরী ও রপ্তানীর মধ্য দিয়ে রপ্তানী আয় বাড়ানোর পাশাপাশি একটি আইনানুগ, নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত, নির্ভরযোগ্য কর্মস্থল হিসেবে গার্মেন্টস কারখানাকে রূপান্তরের তাগিদ অনুভূত হতে থাকে এই শিল্পে। যদিও খুব সীমিত আকারে ও পরিসরে। স্বেচ্ছায় ও আত্মপলব্ধি হতে গার্মেন্টস কারখানায় সবরকম কমপ্লায়েন্স মেনে চলার চেয়ে তখনকার সময়ে বায়ারের চাপ, বাধ্যতামূলক কিছু মানদন্ড মেনে চলা, ন্যুনতম নিরাপত্তা, আইনের সতর্ক ও হিসেবী পরিপালন-এমনটাই ছিল সার্বিক চিত্র। ন্যুনতম হতে একটু বাড়তি (এ্যাডভান্স অর্থে) কিছু করতে পারাটা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং-কারখানা ও কমপ্লায়েন্স কর্মী-সবার জন্যই। আশির শেষ হতে নব্বইয়ের শেষ-এই সময়টা গার্মেন্টস শিল্প হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি আশার প্রতীক, ভরসার নয়। একই সাথে নানা দুর্ঘটনা, সংঘাতপূর্ন শ্রমসম্পর্ক, শ্রম অসন্তোষ-এসবের কারনে দেশে ও বিদেশে সচেতন ও অচেতন-দু’ভাবেই গার্মেন্টস শিল্পের একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়। দেশের মানুষ একই সাথে গার্মেন্টস কে সমীহ ও শ্রদ্ধা করত, অর্থনীতিতে এর অবদান এবং দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য শেষ আশার উৎস হিসেবে। আবার একই সাথে একে বাঁকা দৃষ্টিতেও দেখত। শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত সমাজের কাছে গার্মেন্টস খাত ছিল অপাংক্তেয় অথচ সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের মতো, যাকে না যায় ঘরে তোলা, আবার না যায় অস্বীকার করা। অবশ্য এর একটা বড় কারন হল বাংলাদেশের সমাজের খুবই বিচিত্র ও অব্যখ্যাত শ্রেনী বিভেদ ও শ্রেনী সচেতনতা। গার্মেন্টসে কর্মরত (মূলত সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেনীর) শ্রমিকদের সাথে মুৎসুদ্দী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেনীর শ্রেনী-সংঘাতের বোধই ছিল এর মূল কারন। এর ভিতর দিয়েই খুব নিয়ন্ত্রিত ও ধীর গতিতে হলেও বাংলাদেশে নানা কারনেই গার্মেন্টস কারখানায় কমপ্লায়েন্স উন্নত হতে থাকে।
এই ধারায় ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঘটে যায় দুটি প্রলয়ঙ্করী ঘটনা। তাজরীন কারখানায় আগুনে পুড়ে বিরাট সংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু এবং রানা প্লাজার ধ্বসে কয়েকটি কারখানার হাজারের ওপরে শ্রমিকের তাৎক্ষণিক মর্মান্তিক মৃত্যু দেশে ও বিদেশে গার্মেন্টস কারখানাকে বিশাল ভাবমূর্তির সংকটে ফেলে দেয়। ক্রেতা (বায়ার), তাদের সংগঠন, বিভিন্ন বায়ার দেশের এনজিও, খুচরা ক্রেতাদের সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন (এবং অবশ্যই দেশে বিদেশে গোপনে ষড়যন্ত্ররত নানা সংগঠন) উঠেপড়ে লাগে বাংলাদেশের গার্মেন্টস নিয়ে নেতিবাচক প্রচারনা ও চাপ প্রয়োগে। মনে করা হতে থাকে, এই দুটি দুর্ঘটনার জেরে বাংলাদেশ হতে গার্মেন্টস রপ্তানী ধ্বংস হয়ে যাবে। মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোষাক শিল্প। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান জোনের বায়ার প্রতিষ্ঠানগুলো ALLIANCE ও ACCORD নামে দুটি কনসোর্টিয়াম বানান। যারা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে (মূলত ভবন নির্মান, বৈদ্যুতিক ও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে) দীর্ঘমেয়াদী অডিট, মূল্যায়ন, পরামর্শ, সংশোধন কার্যক্রম শুরু করেন।
তাদের অডিটে বেশ কিছু কারখানা বন্ধও হয়ে যায়। বড় সংখ্যক নামি দামী কোম্পানীর কারখানাও মানদন্ড নিশ্চিত করতে না পারায় বন্ধ হয়। এর সাথে যোগ হয় বিভিন্ন সরকারী সংস্থা, আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার ব্যপক ধরপাকড়। ব্যপক চাপের মুখে পড়ে গার্মেন্টস শিল্প। একদিকে কারখানা বন্ধের ভয়। অন্যদিকে তাদের নির্দেশিত রি-মেডিয়েশন বাস্তবায়নে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের বোঝা। মনে করা হচ্ছিল, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প এবার ধ্বংস হল বলে। তারপরও নানা উপায়ে ও টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে এগোতে থাকে কারখানাগুলোতে অডিট, মূল্যায়ন, রিপোর্টিং, রিমেডিয়েশন, ইমপ্রূভমেন্ট, ভিজিট, সার্টিফিকেশনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর একই সময়ে জনপ্রিয় হতে থাকে ‘গ্রীন ফ্যাক্টরী’ তথা লিড সার্টিফিকেশনপ্রাপ্ত মূলত এনার্জি ও রিসোর্স এফিশিয়েন্ট কারখানা স্থাপন।
সেই মহাপ্রলয়ের ৬ বছর পরে ২০১৯ সালে এসে আমরা দেখতে পাই, বেশ বড় সংখ্যক কারখানা রিমেডিয়েশন কিংবা প্রাথমিক মানদন্ডে উত্তীর্ন না হতে পেরে বন্ধ হয়ে গেলেও, সার্বিকভাবে বাংলাদেশ খুব ভালভাবেই তার সর্ববৃহৎ শিল্প সেক্টরকে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র হিসেবে নতুন করে বিশ্বের দরবারে পরিচীত করাতে পেরেছে। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০টি গার্মেন্টস কারখানার ৭ টির গর্বিত মালিক। সারাদেশের অধিকাংশ কারখানা একর্ড বা এলায়েন্সের কঠোর মানদন্ডে উত্তীর্ন। দেশে তার উপরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৭০ টির মতো গ্রীন কারখানা আর শিগগীরই এই বহরে যুক্ত হতে পারে আরো ৩০০।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের কমপ্লায়েন্সের ইতিবৃত্তকে তাই আমি দুটি মোটা দাগে ভাগ করতে চাই। একটি হল নব্বইয়ের দশকের শেষদিক হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত গতিতে উন্নয়নের যুগ। আরেকটি হল ২০১৩’র পরবর্তি নাটকীয়, দ্রুতগতির ও টেকসই উন্নয়নের যুগ। যেকোনো প্রকারেই হোক, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানার বর্তমান কর্মপরিবেশ ও শ্রমসম্পর্ক সার্বিকভাবে বিশ্বের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চস্তরের।
-কমপ্লায়েন্স বিষয়টির বহুমাত্রিকতা এবং কমপ্লায়েন্স সুনিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জসমূহ:-
আগেই বলেছি, আমার মতে, গার্মেন্টস শিল্পের কমপ্লায়েন্স বিষয়টি বহুমাত্রিক। কোনো একটি একক বিষয় নয়, গার্মেন্টস কমপ্লায়েন্স এর রয়েছে অনেক মাত্রা (ডাইমেনশন)। যেমন:- শ্রম সম্পর্ক, শ্রম সময়, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশ, পরিবেশ ও প্রতিবেশের কমপ্লায়েন্স, বানিজ্য নীতি ও ব্যবসার নৈতিকতার কমপ্লায়েন্স, আর্থিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা, ঝুঁকি ও হুমকী মোকাবেলার সক্ষমতা, ব্যক্তিগত, দলগত, লিঙ্গভিত্তিক, ভৌগলিক, উৎসগত শ্রম স্বীকৃতি ও অবৈষম্যের কমপ্লায়েন্স, শ্রম অধিকার ও শ্রম স্বাধীনতার কমপ্লায়েন্স, ইত্যাদি। এই প্রতিটি মাত্রার আবার রয়েছে বিস্তৃত শাখা প্রশাখা। রয়েছে নানা আইনী ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা। এর ভিতরে কিছু কিছু বিষয় রয়েছে, যেখানে কোনোরকম বাত্যয় একদমই ‘শুন্য সহ্যসীমা’য় (জিরো টলারেন্স); যেমন:- শ্রমমূল্য যথাযথভাবে প্রদান, শিশুশ্রম কিংবা জোরপূর্বক শ্রমদান না করানো, নিরাপত্তার মারাত্মক ত্রূটি, হয়রানি বা নির্যাতন, লাইসেন্সিং-ইত্যাদি। কমপ্লায়েন্স মূলত একটি বহুমাত্রিক বিষয়। বর্ণিত সকল মাত্রায় (ডাইমেনশনের) পুর্ণ বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিকতা রক্ষাই কমপ্লায়েন্স।
একটি গার্মেন্টস কারখানাকে কমপ্লায়েন্ট করে গড়ে তুলতে হলে কোনো একক মানদন্ড বা লিখিত বিধান মেনে চললেই হয়ে যাবে-এমন নয়। বিষয়টি বহুমাত্রিক। কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন, ক্রেতাদের আচরনবিধি (COC), প্রচলিত প্রথা (Practice) এসবের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা ও মতের দ্বন্দ্ব। তবুও, কিছু মৌলিক ও সার্বজনীন বিষয় আছে, যা প্রতিটি আইন বা আচরনবিধিতেই সাধারন (কমোন) এবং যে বিষয়গুলোর লঙ্ঘনকে মারাত্মক লঙ্ঘন বা Zero Tolerance হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন কিছু বিষয়ে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি:-
ক.কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের সার্বিক ব্যবসা পরিচালন (অপারেশনস) দ্বারা ওই স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ দুষিত হতে পারবে না।
খ.প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় আইনগত নথি (Legal Documents) এবং অতি আবশ্যকীয় প্রতিবেদন (Documents) সবসময় হালনাগাদ রাখতে হবে।
গ.প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক পরিচালন রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সকল আইন, অধ্যাদেশ মেনে করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার কোনো পর্যায়ে আইনের বাত্যয় ঘটানো যাবে না।
ঘ.প্রতিষ্ঠানটিকে কোনো রকম আর্থিক বা কাঠামোগত দুর্নীতিতে বা অস্বচ্ছতায় জড়িত হওয়া চলবে না। প্রতিষ্ঠানের কোনোরকম তথ্য, উপাত্ত, হিসাব নিকাশে মিথ্যা তথ্য বা প্রতিবেদন দেয়া চলবে না। প্রতিষ্ঠানকে সব বিষয়ে স্বচ্ছ হতে হবে।
ঙ.কর্মীদের যেকোনোভাবে হয়রানি করা, নির্যাতন করা, বলপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা, লিঙ্গ বৈষম্য করা, যেকোনো রকম বৈষম্যমূলক শ্রমচর্চা বা প্রাতিষ্ঠানিক নীতি অবলম্বন করা যাবে না।
চ.সংগঠন করতে কোনো রকম বাঁধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
ছ.কর্মীবৃন্দ বা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বা সংলগ্ন যেকোনো সুবিধাভোগীর (স্টেকহোল্ডার) জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, সুরক্ষার ঘাটতি সৃষ্টি করা চলবে না। বিশেষত মৃত্যু ঝুঁকি, দুর্ঘটনা ঝুঁকি কিংবা স্বাস্থ্যঝুুঁকি সৃষ্টি হতে পারে-এমন কোনো কার্যক্রম চলতে পারবে না।
বাংলাদেশে কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন কোনোকালেই একদম চ্যালেঞ্জমুক্ত ছিল না। বরং সবসময়ই তা ছিল প্রচন্ড চ্যালেঞ্জিং। সেই চ্যালেঞ্জ ছিল আর্থিক, ছিল কাঠামোগত, ছিল বানিজ্যগত, ছিল নীতিগত আর কিছুটা মানসিকতারও। কমপ্লায়েন্সের নানামুখী চাহিদা ও দাবীকে ইতিবাচক মানসিকতা দিয়ে দেখতে মালিক, শ্রমিক, কমপ্লায়েন্স কর্মী, বায়ার, অডিটর-সব স্তরেই নানামুখী সমন্বয়হীনতা ও দ্বন্দ্বপূর্ণ মানসিকতা সবসময়ই ছিল। যদি খুব সংক্ষেপে আগাগোড়া বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো বলতে হয়, তাহলে বলব-
১.কারখানার বড় সংখ্যক উদ্যোক্তাদের (আমরা সাধারনত মালিক বলে অভ্যস্ত) ইতিবাচক মানসিকতার অভাব আছে প্রচুর। কমপ্লায়েন্স মানাকে বিনিয়োগ ভাবতে অনেকেই এখনো নারাজ।
২.ক্রেতা (ব্র্যান্ড ও বায়ার)দের সহযোগিতার অভাব কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে বড় একটি বাঁধা। এই বাঁধা ও অসহযোগিতা বহুমুখী। সবচেয়ে বড় যেই অসহযোগিতার অভিযোগ নির্মাতা (রিটেইলার/ভেন্ডর)রা করে থাকেন, তা হল, কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে বিপুল অঙ্কের খরচের বিপরীতে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরী পোষাকের বাড়তি কোনো দাম/প্রনোদনা/ভর্তূকী কিছুই দিতে রাজি হন না। ফলে, কমপ্লায়েন্সের জন্য নতুন কোনো বিনিয়োগে বা বড় রকম খরচে, কারখানাকেই নিজের মুনাফা হতে ভাগ (শেয়ার) করতে হয়। তাছাড়াও, ক্রেতাদের স্থানীয় কার্যালয় ও এর কর্মীগন কারখানার কমপ্লায়েন্স বিষয়ক যেকোনো ক্ষেত্রেই অনমনীয় থাকেন। ক্রেতার মূল কার্যালয়ের সাথে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সহযোগি সম্পর্ক নিশ্চিতে তারা খুব একটা গা করেন না বলে অভিযোগ করা হয়। তাছাড়া, প্রায়ই অভিযোগ করা হয়ে থাকে, যে, সরবরাহকারী বা নির্মাতা (ভেন্ডর) প্রতিষ্ঠানের সাধারন শ্রমিকদের তারা বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সে তুলনায় তারা কর্মচারী ও কমপ্লায়েন্স কর্মীদের ততটা গুরুত্ব দেন না।
৩.তৃতীয় পক্ষ নিরীক্ষক (থার্ড পার্টি অডিটিং)দের অতি বানিজ্যিক চিন্তা ও সমন্বয়হীনতা এই ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। ক্রেতাদের সমন্বয়ক বা মূল কার্যালয়ের মতোই তারাও সরবরাহকারী বা ভেন্ডর কারখানার সাথে বিমাতাসূলভ আচরন করে থাকেন-এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।
৪.কমপ্লায়েন্স নিয়ে একটি সার্বজনীন (ইউনিফাইড) মানদন্ড তৈরীর দাবী ধ্বনিত হচ্ছে বহুকাল আগে হতে।
৫.দক্ষ কমপ্লায়েন্স কর্মীর অভাব এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রবল। কর্মজীবন (ক্যারিয়ার) পছন্দ করার অগ্রাধিকারে এমনিতেই গার্মেন্টস পিছনের সারিতে থাকে। তার উপর এখানে যেসব মেধা আসে, তারাও শুরুতেই প্রথম পছন্দ হিসেবে কমপ্লায়েন্সকে বেঁছে নেন না। স্বাভাবিকভাবেই মেধার সন্নিবেশটা কমে যায়। তার উপর কর্মজীবন পথ (ক্যারিয়ার পাথ) কমপ্লায়েন্সে অনেক বন্ধুর ও বিপদসংকুল। তার উপরে আছে, এই ক্ষেত্রের কর্মীদের সত্যিকারের দক্ষতা বাড়াবার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের অভাব। ফলাফল, দক্ষ ও কৌশলগত জ্ঞান সম্পন্ন কর্মীর তীব্র অভাব। তার প্রভাব পড়ে কারখানার কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত কর্মকান্ডে। এই ক্ষেত্রের বিদ্যমান কর্মীরা এই লাইনটি পড়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ার কিছু নেই। অভাব আছে মানে এই নয়, যারা এখন আছেন, তাদের সবাইকে অদক্ষ বা জ্ঞানহীন বলা হয়েছে।
৬.গার্মেন্টস সেক্টরের প্রচন্ড শ্রমিক অভিবাসন (মাইগ্রেশন) ধারা এই সেক্টরের কমপ্লায়েন্স রক্ষায় অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।
৬.উদ্যোক্তা, ক্রেতা, কমপ্লায়েন্স কর্মী-এই তিনটি অংশের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, আস্থাহীনতা ও অসহযোগিতা।
৭.পুর্নাঙ্গ কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।
৮.দীর্ঘমেয়াদী মুনাফা ও টেকসই উন্নয়নে অনীহাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কমপ্লায়েন্সে খরচ করাটা আসলে একরকম দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ। যার সরাসরি প্রতিদান প্রায় বলতে গেলে নেই। দীর্ঘমেয়াদে এই বিনিয়োগ অদৃশ্যভাবে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন ও মুনাফা প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই (এটা বাংলাদেশের অধিকাংশ খাতেই হয়ে থাকে) দীর্ঘমেয়াদী সুফল ও টেকসই উন্নয়নের চেয়ে নগদে ক্ষতি বা খরচটাই বেশি গুরুত্ব পায়।
৯.রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শ্রম অসন্তোষ কমপ্লায়েন্সকে বাঁধাগ্রস্থ করে থাকে।
১০.গার্মেন্টস ব্যবসায় অত্যন্ত নিচু হারের মার্জিন এই খাতের আভ্যন্তরীন কমপ্লায়েন্স উন্নয়নে একটি বড় বাঁধা। অনেকের হয়তো ধারনা নেই, গার্মেন্টস ব্যবসায় সার্বিকভাবে মুনাফার আনুপাতিক হার তুলনামূলকভাবে অন্যান্য খাতের চেয়ে অনেক কম। এখানে বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা ফেরত (রিটার্ন) বা মার্জিন অনেক কম। বিধায় বড় রকমের অর্থ সংস্থান করতে গেলে মূল পূঁজি ভাঙা কিংবা চুড়ান্ত (নেট) মুনাফায় হাত দিতে হয়।
১১.কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত যাবতীয় আইন, কোড, আচরনবিধি, ধারনা, বিধি, কৌশল, প্রকৌশল-এসবের সার্বিক সমন্বয়, কমপ্লায়েন্স চাহিদাসমূহের বাস্তবমুখীতা, যুগপযোগীতা, হালনাগাদ তথ্য ও তত্ত্ব-এসবের সমাবেশ, সমন্বিত কৌশলের ব্যবহার-সবকিছুতেই ব্যপক ঘাটতি।
-কমপ্লায়েন্স ও বাংলাদেশে তার প্রেক্ষিত:-
অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কমপ্লায়েন্সের প্রেক্ষিত খুবই ইতিবাচক তবে তাৎপর্যপূর্ন। তার অন্যতম কারন হল-বিজিএমইএ কর্তৃক ৫০ বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোষাক রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন এবং ২০১৩ পরবর্তি প্রেক্ষাপটে নিজের হারানো ইমেজ উদ্ধার। তদুপরি ২০১৩ হতে এই সেক্টরে রিমেডিয়েশন নামক বহুমুখী সংস্কারে যে বিপুল পরিমান অর্থি লগ্নি করা হয়েছে, তার প্রতিদান ফেরত আনাটা স্বার্থেই কমপ্লায়েন্সের টেকসই ও ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রয়োজন।
অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নানা কারনেই আমাদের এই সেক্টরের উদ্যোক্তাগন কমপ্লায়েন্স বিষয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছেন। ২০০০ সালের দিকেও যেখানে সামান্য একটি ফায়ার এক্সটিংগুইসার বাড়াবার প্রস্তাব করলে প্রত্যাখ্যাত হতে হত, বা অনুমোদন নিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত, সেখানে আজকে কোটি টাকার স্প্রিঙ্কলার কিংবা ফায়ার ডোর লাগাবার প্রস্তাব অনুমোদন করতেও খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে এখন কমপ্লায়েন্সের জন্য পটভূমিটি খুবই ইতিবাচক। হ্যা, সেই পুরোনো যুগের মতো শিশু শ্রম, আগুন লাগা কিংবা শারিরীক নির্যাতনের মতো প্রাথমিক যুগের সমস্যাগুলো নিয়ে আজকাল আর ততটা নাকাল হতে হয় না কমপ্লায়েন্স পেশার মানুষদের। বরং সেই যায়গাটি নিয়ে নিয়েছে শ্রমসম্পর্ক, শ্রমসংঘ, ফেয়ার ওয়েজ, সফিসটিকেটেড টেকনোলজি, এনভায়রনমেন্ট ও ইকোলজি ফ্রেন্ডলী ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন ইত্যাদি। একটা সময় ছিল, যখন ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য বিশেষায়িত ন্যুনতম মজুরী ঘোষনা করে সরকার। ওই মজুরী আনু্ষ্ঠানিকভাবে মেনে নিলেও শ্রমিকপক্ষ, এবং বিশেষত মালিকপক্ষের বিরাট অংশই নীতিগতভাবে ওই মজুরীর সাথে একমত হতে পারেননি। আমার মনে পড়ে, ২০০৬ সালে ন্যুনতম মজুরীর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা-তা নিশ্চিত করতে তৎকালীন বিজিএমইএ পর্ষদ ও এক্সিকিউটিভ বডি বিশাল এক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই সময় সরকার ও বিজিএমইএ একটা পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শতভাগ কারখানায় ন্যুনতম মজুরী কাঠামোর পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে দাবী করে। তারপর আরো ২ টি মজুরী কাঠামো পার হয়ে ২০১৮ সালে সবশেষ ৪র্থ তম ন্যুনতম মজুরী কাঠামো ঘোষনা হল। এখন কিন্তু আর সেই আগের মতো ন্যুনতম মজুরী বাস্তবায়নে কামান দাগতে হচ্ছে না। সামান্য কিছু অসঙ্গতি ও অসন্তোষ থাকলেও সার্বিকভাবে মালিক ও শ্রমিকরা বিষয়টিতে একটি সমঝোতা ও সহাবস্থানে চলে এসেছেন...
পরের পর্বে সমাপ্ত।
Collected From Jagojobs