বাংলাদেশের কারখানাসমূহে কমপ্লায়েন্সের বর্তমান পরিস্থিতি:-
জানেন কিনা, বিশ্বের সর্বাধুনিক ও মানসম্পন্ন ১০ টি তৈরী পোষাক কারখানার ৭টিই এখন বাংলাদেশে। সবমিলিয়ে ওভেন, নীট ও সোয়েটার-তিন খাত মিলিয়ে বাংলাদেশের চালু কারখানার সংখ্যা হবে ২৫০০ হতে ৩৫০০। এর ভিতরে যুক্তরাষ্ট্রের লীড সংস্থা হতে বিভিন্ন ক্যাটেগরীতে লীড অনুমোদিত কারখানা আছে প্রায় ৯০ টি। খুব শিগগীরই আরো অন্তত ৩০০ টি কারখানা যুক্ত হবার কথা এই তালিকায়। একর্ড ও এলায়েন্সের কঠিনতম মানদন্ডেও বাংলাদেশের সিংহভাগ কারখানা এফিলিয়েশন পেয়ে গেছে। তার মানে, বাংলাদেশের পোষাক কারখানার নিরাপত্তা ও নির্মানের মান এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ন্যুনতম মজুরী নিয়ে সবশেষ কাঠামো ঘোষনার আগে ও পরে কিছুদিন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলেও সার্বিকভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত অতীতের সেই চরম অসন্তোষপূর্ন শ্রমসম্পর্ক, আন্দোলন, ধরপাকড়, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের মতো যুগ পার হয়ে এসেছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এই সেক্টর বাংলাদেশের যেকোনো শিল্পখাতের চেয়ে বেশি কমপ্লায়েন্ট। এমনকি শিল্প সম্পর্কজনীত আইন বাস্তবায়নেও এই খাত সবার চেয়ে এগিয়ে। শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন হিসেবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নিজ নিজ সদস্য কারখানাসমূহের সার্বিক নেতৃত্ব দান ও কমপ্লায়েন্স মান রক্ষায় আর যেকোনো শিল্পের চেয়ে অত্যন্ত কঠোর ও দক্ষ। এককভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পেই দেশের সবচেয়ে বেশি আনুপাতিক হারে শিশু যত্ন কেন্দ্র রয়েছে। ম্যাটারনিটি সেবা, সুবিধা ও ছুটি প্রদানে গার্মেন্টস খাত সবচেয়ে এগিয়ে। সিএসআর কর্মকান্ডে গার্মেন্টস খাত স্থাপন করেছে বিরাট নজির। এ সেক্টরে এমন প্রতিষ্ঠানও আছে, যেখানে কয়েক শত প্রতিবন্ধী মানুষ কাজ করেন।
-আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের নানামূখী বৈষম্য ও অসমন্বিত কমপ্লায়েন্স দাবী ও তার সারবত্তা:-
কমপ্লায়েন্স নিয়ে যারা এই সেক্টরে কাজ করেন, তাদের সবারই একটি সাধারন (কমোন) হতাশার নাম “বায়ার”। আমি নিজে যখন কর্পোরেট ছেড়ে ২০০৮ সালে কারখানায় কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করতে আসি, তখন আমার নতুন সহকর্মীদের দেখতাম, তাদের কাছে ‘বায়ার’ একটি মূর্তিমান বিরক্তি ও আতঙ্কের নাম। যদিও সবরকম নিরীক্ষণ ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের সঙ্গে কমপ্লায়েন্স বিভাগ স্বভাবতই জড়িত নয়, কিন্তু খুব অদ্ভূৎভাবে কমপ্লায়েন্স বিভাগের কর্মীদেরকে কারখানায় সংঘটিত সবরকম নিরীক্ষণ (অডিট) এর কাজের জন্য জবাবদিহিতা করতে বাধ্য হতে হয়। কারখানায় সাধারন যেসব অডিট হয়ে থাকে, তার মধ্যে রয়েছে:-সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স অডিট, এনভায়রনমেন্টাল অডিট, সিকিউরিটি অডিট (CTPAT/GSV), সেফটি অডিট, জিপিকিউ বা আরকিউএস অডিট, টেকনিক্যাল অডিট ইত্যাদি। এর মধ্যে কেবলমাত্র প্রথম দুটিতে কমপ্লায়েন্স বিভাগ সরাসরি জড়িত। বাকিগুলো তার নিজের কাজ না হলেও, ওই অডিটগুলো সংঘটিত হবার সময়ে কমপ্লায়েন্স বিভাগের কর্মীদের অন্তর্ভূক্ত (ইনভলভড) হতেই হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি তাদেরকে রীতিমতো জবাবদিহীও করতে হয়।
কমপ্লায়েন্স নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সবারই একটি সাধারন (কমোন) চাহিদা হল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি সাধারন (কমোন) বা ইউনিফাইড কোড অব কনডাক্ট প্রণয়ন। যদিও এমন একটি সার্জননীন (ইউনিফাইড) কোড করার জন্য অনেকবার অনেক রকম উদ্যোগই নেয়া হয়েছে, বিভিন্ন ফোরামে তা উত্থাপন ও আলোচনা হয়েছে, চেষ্টাও হয়েছে এমন একটি কোড প্রণয়নের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। আর সত্যি বলতে কি, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য বায়ার এবং সাপ্লায়ার, অডিটিং ফার্ম, সার্টিফিকেশন বডি-সবাইকে নিয়ে এমন একটি কল্পিত সার্বজনীন (ইউনিফাইড) কোড অব কনডাক্ট প্রণয়ন করাটা কিছুটা আকাশ কুসুম কল্পনাও বটে।
কিন্তু অমন একটি সাধারন বা সার্বজনীন কোড না থাকায় বিপদে ও বিপত্তিতে পড়ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। আরো বিশেষভাবে বললে, কমপ্লায়েন্স পেশাজীবিগন। তারা একটি কারখানার অন্তত ১০ টি আলাদা ক্রেতা (বায়ার) এর আলাদা আলাদা কোড অব কনডাক্ট, আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি, নিজস্ব ধরন ধারন, নিজস্ব ব্যখ্যা, নিজস্ব মানদন্ড-এসবের সাথে তাল মিলাতে পারছেন না। তাছাড়া প্রায়ই দেখা যায়, এক বায়ারের যা মানদন্ড, তা অন্যজনের মানদন্ডের সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া আলাদা মানদন্ড’র সাথে সমন্বয় করতে গিয়ে কারখানাকে পড়তে হচ্ছে নানা বিপত্তিতে। বায়ারদের বা তাদের নিযুক্ত অডিট ফার্মের কর্মীদের ভিতরেও রয়েছে অবাস্তবমুখী চাহিদা বা দাবী করা, চাপিয়ে দেয়া, অসহিষ্ণুতা, বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার মানসিকতা। ফলাফল, কমপ্লায়েন্স কর্মীদের মাথায় হাত। একটি কারখানার অভিজ্ঞতা বলি। বায়ারের নিরীক্ষক (অডিটর) আপত্তি দিয়েছেন, কারখানা ছুটির সময়ে একটি কারখানার কিছু কিছু কর্মী ২০ হতে ২৫ মিনিট পরে কার্ড পাঞ্চ করে বের হয়েছে। অথচ সেই খুচরা ২০-২৫ মিনিটের কোনো টাকা তারা পাননি। কারখানা কর্তৃপক্ষ খোঁজখবর নিয়ে দেখেন, ওই কর্মীরা নিজস্ব কাজেই দেরী করে বের হয়েছেন এবং তাদের সহকর্মীরাসহ বাদবাকি লাইন, সব ৫ টাতেই ছুটি হয়ে গেছে। আর তাছাড়া, গার্মেন্টসে একটি চেইনে কাজ হয়। এককভাবে একজন দুজন কর্মীর পক্ষে আলাদা করে ২০-২৫ মিনিট অতিরিক্ত কাজ করাটা (প্রায়) অসম্ভব। কিন্তু নিরীক্ষক কিছুতেই সেটি মানতে রাজি নন। অথচ ওই একই কারখানায় আরো ৪/৫ টি বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওই তথ্য জেনেই কাজ দেন। তাদের এতে কোনো অসুবিধা নেই।
এই বিপদের সাথে যুক্ত হয়েছে, দেশীয় প্রচলিত আইন ও বিধানসমূহের নানা অসঙ্গতি। যেসব আইন, বিধান ও প্রবিধান এই সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তার মধ্যে প্রনিধানযোগ্য হল:-ক.বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রমবিধি ২০১৫ খ.বাংলাদেশ ভবন আইন বা বিএনবিসি গ.বাংলাদেশ বন সংরক্ষণ আইন ঘ.বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ঙ.ভ্যাট আইন চ.আয়কর আইন। অনেক ক্ষেতেই দেখা গেছে, এই আইনগুলোর অনেক প্রবিধান গার্মেন্টস সেক্টরে প্রয়োগযোগ্য নয়। কিংবা প্রবিধানটি এখনকার সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনায় বাস্তবসম্মত বা ব্যবসা বান্ধব নয়। এই গোটা উপমহাদেশেই রাষ্ট্র পরিচালনায়, তথা আইন প্রণয়নে যুগপযোগীতা ও বাস্তবতার চেয়ে আবেগ ও সংখ্যাগুরুর (পপুলার মেজরিটির) মতামত বেশি প্রতিফলিত হয়। ফলাফল, আইনের মাঠ পর্যায়ের প্রয়োগে সমস্যার সৃষ্টি। এখন পর্যন্ত গার্মেন্টস সেক্টরকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিনিধিত্ব করে-এমন কোনো মন্ত্রনালয় নেই। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, “তৈরী পোষাক শিল্প” হিসেবে কোন শিল্পটিকে বোঝাবে-তার সংজ্ঞা ও সীমানা নির্ধারনই এখনো হয়নি। ফলে গার্মেন্টস সেক্টর তার কোনো রাষ্ট্রীয় অভিভাবক পায় না। একই ধারায় এই শিল্পের সাথে জড়িত অন্যান্য পশ্চাৎমুখী (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) ও সম্মুখমুখী (ফরোয়ার্ড লিংকেজ) শিল্পগুলোও আছে বিপদে। সরকার প্রণীত বিভিন্ন আইন যা এই সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ করা হয়, সেগুলো ঠিক কোন কোন শিল্পে, কোন ধরনের কারখানায় কী কী প্রেক্ষিতে অর্পিত হবে-সেটা এখনো স্পষ্ট নয়, যেমন: গার্মেন্টস সেক্টরের ন্যুনতম মজুরী আইন বা প্রজ্ঞাপন (গেজেট)। উদাহরন স্বরুপ যদি বলি, একটি বাটন কারখানা, যেটি গার্মেন্টস শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন এটি কি গার্মেন্টস শিল্পের অন্তর্ভূক্ত? অানুষ্ঠানিকভাবে (ফরমালি)? মনে হয় না। যদি তা নাই হয়, তাহলে তার ওপর কোন শ্রম আইন প্রযোজ্য (হ্যা, অব্যহতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্র বাদে বাকি সবাই গড়ে হরিবোল হিসেবে ওই ২০০৬ আইনের আওতায় ঠিকই।)? আবার একটি তৈরী পোষাক কারখানার একই প্রাঙ্গনে (কমপাউন্ডে) যদি একটি বাটন কারখানা থাকে, আর আরেকটি ধৌতকরণ (ওয়াশিং প্ল্যান্ট) কারখানা থাকে, তাহলে তারা কোন আইন বলে চালিত হবে? তার উপর তো আগে হতে আছেই, বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ ও এর ২টি সংশোধনী নিয়ে নানা অসঙ্গতি ও অবাস্তব বিধির অভিযোগ। মূল আইন, এর বিধি এবং সবকিছুর ২ দফা সংশোধনের পরেও এই আইনে রয়ে গেছে অসংখ্য অসঙ্গতি, অবাস্তবতা, বাস্তববিমূখীতা, আত্মবিরোধিতা এবং অপূর্নতা। তার উপর আছে বায়ার ও নিরীক্ষা (অডিট) কর্মীদের নিজস্ব চাপিয়ে দেয়া দৃষ্টিভঙ্গির যন্ত্রণা। সবশেষ একর্ড ও এলায়েন্সের নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরুর পরে বিগত ৩/৪ বছরে বাংলাদেশের তৈরী পোষাক কারখানাগুলোকে ভবন নির্মান, নিরাপত্তা ও ঝুঁকি মোকাবেলার বিভিন্ন বিধি ও প্রকৌশলগত দিক নিয়ে নাকানি চুবানি খেতে হয়েছে। অবাস্তব ও এদেশের সার্বিক কাঠামোর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ন নানারকম সংশোধন দাবী চাপিয়ে দিয়ে বিপদে ফেলা হয়েছে কারখানাকে। সবমিলিয়ে কমপ্লায়েন্স কর্মীদের দফারফা।
-কমপ্লায়েন্ট কারখানা ও প্রতিষ্ঠান তৈরীর উপায় ও সুবিধাসমূহ:-
অনেকেই মনে করতেন বা এখনো হয়তো করেন, কমপ্লায়েন্স হল একটি খরচ ও অপব্যায়ের খাত। আসলে তা মোটেই নয়। বরং আমি এটিকে বলব, কৌশলগত বিনিয়োগের খাত। এই বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদী সুফল বয়ে আনে। তার উপর কমপ্লায়েন্ট বিজনেস অপারেশনস ও পলিসি টেকসই বানিজ্য উন্নয়ন নিশ্চিত করে। বিশেষত বর্তমান সময়ে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ ব্যতিত কারখানার কার্যক্রম শুরুই করতে দেয়া হবে না। আর চালু কারখানায় অবিচ্ছিন্ন ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে চাইলে কমপ্লায়েন্স মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। যদিও বর্তমানে সবুজ কারখানা করার বিপুল বিনিয়োগের বিপরীতে তেমন কোনো দৃশ্যমান আর্থিক প্রতিদান পাওয়া যাচ্ছে না-এমন একটি গোপন হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে গার্মেন্টস সেক্টরে। তবে বিষয়টিকে আরেকটু তলিয়ে দেখলে সমস্যার বা হতাশার কিছুটা সমাধান হয়। তা হল:
ক.সবুজ কারখানা তৈরী করলে তা আগে করতে হবে নিজস্ব দায়বোধ হতেই। যতটা না আর্থিক লাভের আশায়।
খ.দীর্ঘমেয়াদে এই কারখানা আর্থিক সাশ্রয়ের মধ্য দিয়ে লাভ বাড়িয়ে দেয়।
গ.ভবিষ্যতে ক্রেতাগণ ব্যপকহারে সবুজ কারখানাকে ক্রয়াদেশ দেবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার (বা হয়তো একমাত্র অধিকার) দেবেন।
*[(গ্রীন ফ্যাক্টরী, যা মূলত LEED এফিলিয়েটেড ফ্যাক্টরী। লীডের অনেকগুলো ধাপ আছে। গ্রীন দাবী করা সবাই একই স্তরের না, মানে সবাই প্লাটিনাম বা গোল্ড না। গ্রীনের কয়েকটি ধাপ আছে-প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভার, সার্টিফায়েড। বাংলাদেশে অনেকেরই ধারনা, গ্রীন ফ্যাক্টরী মানেই সব পেক্ষিতেই (আসপেক্ট) হতে অসামান্য মানের কারখানা, যা আসলে ভুল। সবুজ (গ্রীন) কারখানা বলতে শুধুমাত্র শক্তি (এনার্জি) দক্ষ (ইফিশিয়েন্ট) ও পরিবেশ বান্ধব স্থাপনা ও ভৌত পরিচালনাকে বোঝায়।]
একটি কারখানাকে সার্বিকভাবে কমপ্লায়েন্টলী পরিচালনা (অপারেট) করলে সামগ্রিকভাবে তার সুবিধাভোগী হন কারখানার উদ্যোক্তা (মালিক হিসেবে পরিচীত), শ্রমিক (ও স্ট্যাফ), সরবরাহকারী (সাপ্লায়ার ও কন্ট্রাকটর), ক্রেতা (ব্রান্ড), খুচরা ক্রেতা (সাধারন খুচরা ক্রেতা) এবং এই শিল্পের সাথে জড়িত সবাইই। কীভাবে সেটা ঘটে?
ক.গার্মেন্টস শিল্প আসলে একটি শৃঙ্খল (চেইন) মেনে পরিচালিত হয়। এই শৃঙ্খলে কারখানা একটি বড় নিয়ামক। সে এবং তার যাবতীয় পরিচালন (অপারেশন) যদি কমপ্লায়েন্ট হয়, তবে সেই শৃঙ্খলে থাকা সবার জন্যই তা মঙ্গল বয়ে আনে।
খ.শ্রমিকের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ, সুরক্ষিত, সুবিধাদায়ক, ফলদায়ক, উপকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা সম্ভব কমপ্লায়েন্স অনুসরনের মধ্য দিয়ে।দ
গ.প্রতিষ্ঠানটির জন্য টেকসই (সাসটেইনেবল) ও ক্রমবর্ধমান (ইমার্জিং) একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা করার পথ প্রশস্ত হয়।
ঘ.কমপ্লায়েন্ট কারখানা পরিচালন পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রের পরিবেশ, প্রতিবেশ, বায়ুমন্ডল, প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন ঘটায় কমপ্লায়েন্স অনুসরন।
ঙ.সার্বিকভাবে কমপ্লায়েন্স গার্মেন্টস কারখানা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনগত, সামাজিক উন্নয়নের অংশীদার।
-কমপ্লায়েন্স নিয়ে শিখবার মতো প্রতিষ্ঠানসমূহ ও কমপ্লায়েন্সে ক্যারিয়ার:-
বর্তমানে ক্যারিয়ার হিসেবে কমপ্লায়েন্স প্রোফেশনালদের খুবই উজ্জল সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে গার্মেন্টস সেক্টরে বিগত বছরগুলোতে। বাইরে হতে যেমনটাই মনে হোক না কেন, গার্মেন্টস সেক্টরে প্রচুর উচ্চশিক্ষিত তরুণরা কাজ করছেন এবং নতুন করে কাজ করতে আসছেন। যদিও কেউ কেউ ধারনা করে থাকেন, গার্মেন্টস সেক্টরে কমপ্লায়েন্স প্রোফেশনালরা তুলনামূলক পিছিয়ে থাকেন অন্যান্য পেশাজীবিদের থেকে। তবে এই ধারনা একেবারেই অমূলক। নিজ নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা ও চেষ্টা থাকলে গার্মেন্টস সেক্টরে কমপ্লায়েন্স প্রোফেশনাল হওয়াটা এখন খুবই বর্ধিষ্ণু ও সম্ভাবনাময় একটি পেশা। কল্পনা করুন। দেশে যদি মোটামুটি এখন হাজার তিনেক কারখানাও চালু থাকে, তার প্রতিটিতে সোশ্যাল, এনভায়নমেন্টাল, কেমিক্যাল, সেফটি, ওয়েলফেয়ার-এই সেগমেন্টগুলোতে গড়ে ৪ জন করে কর্মী লাগলেও এ খাতে ১২,০০০ লোকের চাহিদা রয়েছে। তার উপর কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করবার জন্য অডিটিংসহ প্রচুর রিসোর্স প্রতিষ্ঠান ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেখানেও হাজার হাজার দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হয়েছে। আর ২০১৩ সালের পরে এই সেগমেন্টে সুদক্ষ, সুশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ কর্মীদের চাহিদা, মূল্যায়ন, ক্ষমতায়ন হয়েছে জ্যামিতিক মাত্রায়। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে যেকোনো বিষয় নিয়ে স্নাতক করা তরুণরা এই পেশায় আসতে পারেন (এখনও)। তবে আপনি অন্যদের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবেন, যদি আপনার একটি বিশেষায়িত ডিগ্রী (সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স, কেমিস্ট্রি বা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি, আইই, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ইত্যাদি) থাকে।
আপনি যদি একজন কমপ্লায়েন্স প্রোফেশনাল হয়ে থাকেন, কিংবা হবার স্বপ্ন দেখেন, কীভাবে আপনি প্রস্তুত হবেন আপনার উজ্বল, সম্ভাবনাময় কমপ্লায়েন্স ক্যারিয়ারের জন্য? বা আপনার প্রস্তুতির ক্ষেত্রগুলো কী হতে পারে? দেখুন তো, কাজে লাগে কিনা-
ক.কমপ্লায়েন্সে কাজ করার জন্য ইংরেজি জানা ও স্মার্টলী (স্মার্ট এর উপযুক্ত বাংলা পাইনি) যোগাযোগ (কমিউনিকেট) করতে পারাটা একটি অাবশ্যকীয় যোগ্যতা। সেটি রপ্ত করুন।
খ.শ্রম আইন ২০০৬ শ্রম অধিকার ও শ্রম সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ভিত্তি। শ্রম আইনের প্রধান অংশগুলো নিয়ে পড়াশোনা করুন।
গ.কারখানা স্থাপন, পরিচালনা ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য বেশ কিছু বিধি ও আইন রয়েছে। সেগুলো সম্পর্কে মৌলিক ধারনা রাখুন।
ঘ.আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি, প্রকৌশল, সামাজিক মাধ্যম, যোগাযোগ মাধ্যম (কমিউনিকেশন মিডিয়াম) ব্যবহারে অভ্যস্ততা আপনাকে সাহায্য করবে।
ঙ.সংযোগ (নেটওয়ার্কিং) ও পেশাদার সংঘবদ্ধতা (প্রফেশনাল কানেকশন) আপনার জন্য খুব দরকারী এক হাতিয়ার।
চ.গুছিয়ে লিখতে পারার ক্ষমতা একজন দক্ষ কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তার বাড়তি যোগ্যতা।
ছ.যুক্তি উপস্থাপন, যৌক্তিকতা, প্রতিরোধ (নেগোসিয়েশন, রিজনিং, ডিফেন্ডিং)-তিনটি গুন আপনাকে সফল হতে সাহায্য করবে।
জ.চলমান কমপ্লায়েন্স কর্মীর জন্য একটি দৈনিক, মাসিক পরীক্ষা তালিকা (চেকলিস্ট) করে নেয়াটা অত্যন্ত জরুরী। সেই তালিকাটি হবে প্রতিষ্ঠানকে কমপ্লায়েন্ট করবার জন্য কমপ্লায়েন্সের সবরকম মাত্রা (ডাইমেনশন) নিয়ে।
ঝ.কমপ্লায়েন্সে যদি ইতোমধ্যেই কাজ করেন, কিংবা আপনি উতলা (প্যাশনেট) হন, যে, কমপ্লায়েন্সেই কাজ করবেন, তবে এই নিয়ে কিছু বুনিয়াদি (হার্ডস্কিল) প্রশিক্ষণ আপনাকে এগিয়ে রাখবে।
ঞ.সব কমপ্লায়েন্স পেশাজীবির মধ্যে বোধহয় একটা স্বপ্ন থাকে, একজন প্রধান নিরীক্ষক (লীড অডিটর) হবার। মর্যাদা (স্টাটাস) বিচারে যেকোনো তৃতীয় পক্ষ (থার্ড পার্টি) বা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান (বায়ীং) এর নিরীক্ষক (অডিটর) হওয়াটা বেশ আকর্ষনীয় পেশা। সেক্ষেত্রে পেশা শুরু করার পরে কিছু বছর কাজ করে ফেলবার পরে একটি লীড অডিটর সনদ (সার্টিফিকেট) নেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
চ. বিভিন্ন ব্রান্ড (বাংলা নেই), ক্রেতার (বায়ারের) আচরনবিধি (কোড অব কনডাক্ট) ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সনদায়ন (সার্টিফিকেশন) সম্পর্কে ধারনা নিন।
বর্তমানে দেশে কমপ্লায়েন্স ক্যারিয়ারের বর্ধিত চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রচুর রিসোর্স প্রতিষ্ঠান ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাই এই বিষয় নিয়ে বিশেষায়িত পড়াশোনাও করা যায়। সরাসরি গ্রাজুয়েশন ইন কমপ্লায়েন্স না থাকলেও আংশিক বা প্রান্তিকভাবে বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে এখন গ্রাজুয়েশন করা যায়। তার উপর রয়েছে কমপ্লায়েন্স নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স, সার্টিফিকেশন কোর্স, অডিটর কোর্স, সমপিটেন্সি কোর্স করার সুযোগ। এরকমই কিছু প্রতিষ্ঠান হল:-BUFT, GSCS, SMS, BSAHRP, BOLD, BAPS, HACS, WARD, STARTBIZ, Bdjobs, UIU, BIM, SAI, BCPS, IMPACT, Intertek, SGS, BV ইত্যাদি। এর বাইরেও প্রচুর প্রতিষ্ঠান আছে। সবগুলোর নাম আমারও জানা নেই। কিছু নাম উদাহরন হিসেবে দিলাম। এরা সবাই শুধুমাত্র কমপ্লায়েন্সের স্পেশালাইজড ট্রেনিং করান না। কিছু কিছু সাপোর্টিভ ও সংশ্লিষ্ট সফটস্কীল ট্রেনিংও করান। একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।
লেখার বিশাল বপুর জন্য অত্যন্ত লজ্জিত। আসলে বিষয়টি নিয়ে একটু খোলামেলা কথা বলতেই এত বড় করতে হল। সবশেষে বলব, কমপ্লায়েন্স মূলত মানসিকতা, প্রতিশ্রুতি ও সদিচ্ছার সম্মিলন। আর একটি কারখানা বা প্রতিষ্ঠানকে কমপ্লায়েন্ট করতে বিনিয়োগকারীদের সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতিই সবচেয়ে বেশি দরকার। আর কারখানাকে কমপ্লায়েন্ট রাখতে গেলে যে দুটি জিনিস খুব খেয়াল রাখবেন, তা হল-সবগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগকেই তাদের যার যার করণীয় কাজটি বিধি ও SOP মেনে করতে হবে। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা শুধুমাত্র কমপ্লায়েন্স বিভাগের কাজ নয়। আর সবসময় মনে রাখতে হবে, শতভাগ কমপ্লায়েন্ট বা চুড়ান্ত কমপ্লায়েন্স বলে কিছু নেই। কমপ্লায়েন্স উন্নয়নের কোনো শেষ নেই।
Collected From Jagojobs