Facebook Youtube Twitter LinkedIn

বিসিএস ‘পাস’ করে চাকরি না পাওয়া

image

গত কয়েক বছর বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল যখন ঘোষিত হয়, পাশাপাশি একটি খবর প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। তাতে বলা হয়, যে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থী ‘পাস’ করেছিলেন, ‘পদস্বল্পতার’ কারণে তাঁদের অনেকেই চাকরি পাননি। খবরের ‘টোনে’ তাঁদের প্রতি একধরনের সহানুভূতিও দৃশ্যমান হয়।

বিসিএস পাস করে কোনো একটি ক্যাডারে চাকরি পাওয়া তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের স্বপ্ন। ১৯৮৪ সাল থেকে বিভিন্ন ক্যাডারের ব্যাপক সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ স্বপ্নদর্শীর সংখ্যাও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। সর্বশেষ সমাপ্ত ৪০তম বিসিএসে কমবেশি দুই হাজার পদের বিপরীতে দরখাস্ত করেছিলেন চার লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৬ জন। এই বিপুলসংখ্যা থেকে লিখিত পরীক্ষার জন্য যোগ্য হয়ে অংশ নিয়েছিলেন ১৮ হাজার ১৬২ জন এবং পাস করেছিলেন ১০ হাজার ৯৬৪ জন। নিয়মানুযায়ী, এই ১০ হাজার ৯৬৪ জনকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়েছিল, যার মধ্যে ১০ হাজার ১৩৪ জনই মৌখিকে কৃতকার্য হন। সর্বশেষ বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৯৬৩ জন নিয়োগ পান। অর্থাৎ আট হাজারের বেশি প্রার্থী ‘পাস’ করেও চাকরি পাননি।

এরূপ ‘পাস’ করে যাঁরা ক্যাডার পাননি, তাঁদের মধ্যে থেকে ক্যাডারবহির্ভূত বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার একটি প্রথা চালু হয়েছে। ব্যবস্থাটি ভালো, কারণ ক্যাডার যদিও পাননি, তাঁরা একটি নির্বাচনপদ্ধতির মধ্য দিয়ে এসেছেন এবং তাঁদের মৌলিক যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। পত্রিকায় দেখলাম, এখন থেকে ক্যাডারবহির্ভূত পদগুলোতেও অপশন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে বিসিএসের আবেদনের সময়। তা যদি হয়, ভবিষ্যতে তাঁদের মর্যাদা নিয়ে না আবার আইনি লড়াই শুরু হয়, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে অনুরোধ করব।

‘পাস করেও চাকরি পাননি’—এ ধারণা আসলে একটি ভুল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অলিম্পিকে দৌড় প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে আসেন বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে দৌড়বিদেরা। ‘হিট’–এর মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকায় রাখা হয় ছয়জনকে। তার মধ্যে তিনজন সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জের পদক জেতেন। বাকি তিনজন বাড়ি ফিরে যান অকৃতকার্য হয়ে। বিসিএস একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সে কয়জনই ‘পাস’ করেছেন বলে ধরা হবে, যাঁরা চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়ে নিয়োগ লাভ করেছেন। অন্যরা অকৃতকার্য হয়েছেন, পাস করেননি, এটাই বাস্তবতা।

বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কারণে সরকারি চাকরি এখন তরুণদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। দুঃখজনকভাবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং যোগ্যতার প্রায়ই সমন্বয় ঘটে না। বাস্তবতা হচ্ছে বেশির ভাগ তরুণের প্রতিযোগিতামূলক এ পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার যোগ্যতা নেই। অনেককেই দেখা যায় চার থেকে পাঁচবার পরীক্ষা দিয়ে অসফল হওয়ার পর এতে ক্ষান্ত দেন।
বিসিএসের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর সবচেয়ে চাপ পড়ে দুটি ধাপে। প্রথমত, প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য লাখ লাখ প্রার্থীর আবেদন যদিও অনলাইনে হয়, তাঁদের পরীক্ষা নিতে হয় হলে বসিয়ে। এটি একটি প্রকৃতই দক্ষযজ্ঞ। এ পর্যায়ে প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রার্থী বাদ পড়েন। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব।

আসা যাক পরবর্তী পর্যায়ে। সহজ নয় যদিও, ১৮ হাজার পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষা তবু নাহয় নেওয়া গেল, যেহেতু তাঁদের খাতা মূল্যায়নও করবেন অনেকে মিলে। কিন্তু ১১ হাজার প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা কী করে নেওয়া সম্ভব! এই প্রার্থীদের প্রত্যেকের মূল্যায়ন করতে হচ্ছে এক এক করে। ১৯৮১ ব্যাচ বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল ১৯৬টি। এই নিয়োগের জন্য ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে আমরা পাস করেছিলাম মাত্র ১৭১ জন! ফলে মৌখিক পরীক্ষায় মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিলেন বোর্ডের সদস্যরা। আমার ভাইভা ছিল ৪০ মিনিট। লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে আর যাঁরা ওপরের দিকে ছিলেন, তাঁদেরও এমনই। পরবর্তী পরীক্ষা থেকে লিখিত পরীক্ষার পাস নম্বর ৫ শতাংশ কমিয়ে করা হয় ৪৫ শতাংশ এবং ফলে পদসংখ্যার চেয়ে বেশি সফল প্রার্থী পাওয়া সম্ভব হয়। কালক্রমে এ সংখ্যা বাড়তে থাকায় পরবর্তীকালে লিখিত পরীক্ষায় পাস নম্বর আবার ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।

তাতে অবশ্য লিখিত পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীর সংখ্যা কমেনি। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে মেধাবী প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে বিপুলভাবে, যদিও সার্বিক পরিস্থিতি তা বলে না। বরং যে পরীক্ষকেরা খাতা দেখেন, তাঁরা পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫–এর জোয়ারে অভ্যস্ত বিধায় নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে অকৃপণ, এ সম্ভাবনাই বেশি। যা–ই হোক, লিখিত পরীক্ষায় পাস করা এই বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে সঠিক মূল্যায়ন কঠিন হয়ে পড়ে।

নির্বাচনব্যবস্থার ওপর চাপ কমানোর জন্য প্রথমেই প্রিলিমিনারি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার। বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কারণে সরকারি চাকরি এখন তরুণদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। দুঃখজনকভাবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং যোগ্যতার প্রায়ই সমন্বয় ঘটে না। বাস্তবতা হচ্ছে বেশির ভাগ তরুণের প্রতিযোগিতামূলক এ পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার যোগ্যতা নেই। অনেককেই দেখা যায় চার থেকে পাঁচবার পরীক্ষা দিয়ে অসফল হওয়ার পর এতে ক্ষান্ত দেন। দুটি কাজ করা যায় এ সংখ্যা কমানোর জন্য। প্রথমত, আবেদনের যোগ্যতা বাড়িয়ে দেওয়া যায় স্নাতকে প্রাপ্ত গ্রেডে উচ্চতর মাপকাঠি রেখে। দ্বিতীয়ত, দুবার অকৃতকার্য হয়ে তৃতীয়বার কেউ আবেদন করতে চাইলে এর জন্য বেশ খানিকটা উচ্চতর ফি ধার্য করা যেতে পারে। আবেদনকারীর সংখ্যা অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারলে কমিশনের ওপর অহেতুক এবং ক্ষতিকর চাপ কমে আসবে।

মৌখিকে মূল্যায়ন উন্নততর করার জন্য লিখিত পরীক্ষায় পাসের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। দুভাবে এটা করা যেতে পারে। পাসের নম্বর করে দেওয়া যেতে পারে ৬০ শতাংশ। অথবা প্রশ্ন আরও কঠিন করা যায় এবং গতানুগতিকতার বাইরে প্রশ্ন করা যায়, যাতে কোচিং বা মুখস্থবিদ্যা কম কাজে আসে। বিজ্ঞাপিত পদের দ্বিগুণ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় পাস করলেই যথেষ্ট। বোর্ড তখন একটু বেশি সময় নিয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে পারবে। ফলে মূল্যায়ন যেমন উন্নততর হবে, ‘পাস’ করে চাকরি না পাওয়ার সংখ্যাও কমে আসবে।

বিসিএস নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, উপসংহারে পদোন্নতি প্রসঙ্গ একটুখানি আলোচনা করা যায়। ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর ২১৩ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সর্বমোট শ চারেক পদের বিপরীতে তাঁদের নিয়ে সরকারের যুগ্ম সচিবের সংখ্যা তখন ৮০৩। এই অরাজকতা সত্ত্বেও কিন্তু পদোন্নতি–বঞ্চনার হতাশা শেষ হয়ে যায়নি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন আর তা করতে হলে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ কমাতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ হওয়া উচিত শুধু স্বল্পসংখ্যক মেধাবী চৌকস তরুণের, পদোন্নতি নিয়ে যাঁদের দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না। নিচের দিকে অধিকাংশ পদে নিয়োগ ও পদায়ন করতে হবে দ্বিতীয় একটি ধারার কর্মকর্তাদের, সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার যোগ্যতা, সুযোগ বা প্রত্যাশা যাঁদের থাকবে না। পদোন্নতি নিয়ে হতাশা আসলে প্রত্যাশার সমস্যা।

মতামত
মো. তৌহিদ হোসেন 
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

Collected from Prothom alo