গত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৬টি পণ্য উদ্ভাবন করেছে। বর্তমানে ১৫ জন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীসহ ৬১টি পদের বিপরীতে ৬০ জন কর্মরত রয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানে। গবেষণাগারে ২০০–এর বেশি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রয়েছে।
প্রশাসনিক ভবন থেকে গবেষণাগারে চলাচলের রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দেবদারুগাছ। আছে নানা রকমের ফুল গাছও। চত্বরে আছে আবাসিক ভবন, তিনটি গবেষণাগার, মিনারেল প্রসেসিং সেন্টার, অতিথি ভবন, মসজিদ, ডরমিটরি। আছে পুকুর ও একটি বিশাল খেলার মাঠ। ছিমছাম পরিবেশে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারোলজি অ্যান্ড মেটালার্জি (আইএমএমএম)। এটি দেশের একমাত্র খনি, খনিজ ও ধাতব বস্তুসংক্রান্ত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। এক যুগ ধরে সফলতার সঙ্গে কাজ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
আইএমএমএম সূত্রে জানা যায়, জয়পুরহাটে শহরের খঞ্জনপুর এলাকায় ৮ দশমিক ৮১ একর জমির ওপর অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের ৩০ জুন কার্যক্রম শুরু করে। ২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন করেন। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন, মানোন্নয়ন, শিল্পকারখানা স্থাপন এবং কর্মসংস্থান, দেশ ও জাতির আর্থসামাজিক উন্নয়ন। গত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৬টি পণ্য উদ্ভাবন করেছে। বর্তমানে ১৫ জন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীসহ ৬১টি পদের বিপরীতে ৬০ জন কর্মরত রয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানে।
আইএমএমএম পরিচালক ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম জামান। তাঁর কক্ষে এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে উদ্ভাবিত কয়েকটি পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সিরামিক টাইলস। দেয়াল, ছাদের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে ব্যবহার করা যাবে এ টাইলস। নাজিম জামান জানালেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের ধামুইরহাটের লালমাটি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা পাথরের গুঁড়ার সংমিশ্রণে উচ্চ সহনশীল এ টাইলস উৎপাদন করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বল্প খরচে ও নিম্ন তাপমাত্রায় সিরামিক টাইলস উৎপাদন করা হয়েছে।
গবেষণাগারে আর কী কী উদ্ভাবন করা হয়েছে, জানতে চাইলে আইএমএমএমের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সানজিদা সুলতানা বলেন, পরিবেশ রক্ষায় তাঁদের প্রতিষ্ঠান নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পরিত্যক্ত বেভারেজ ক্যান থেকে অ্যালুমিনিয়াম আহরণ করা হয়েছে। উদ্ভাবিত পণ্যটি অ্যালুমিনিয়াম বার তৈরিতে পুনর্ব্যবহার করা যাবে। অন্যদিকে অ্যালুমিনিয়াম কারখানার ছাই থেকে অ্যালুমিনিয়াম সালফেট উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা সাধারণত পানি পরিশোধন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চামড়াশিল্পের বর্জ্য থেকে কপার সালফেট ও ক্রোমিক অ্যাসিড উদ্ভাবন করা হয়েছে।
কপার সালফেট চামড়া প্রক্রিয়াকরণে অব্যবহৃত চুনের পানি থেকে তৈরি করা হয়েছে। উদ্ভাবিত পণ্যটি সাধারণত রংশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ফল পাকানোতে এবং রাসায়নিক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ক্রোমিক অ্যাসিড চামড়াশিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি করা হয়েছে, যা সাধারণত রংশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ধানের তুষ থেকে সিলিকা জেল এবং তুষের ছাই থেকে জিওলাইট উদ্ভাবন করা হয়েছে। সিলিকা জেল পণ্যের জলীয় বাষ্পের শোষক হিসেবে কাজ করে এবং জিওলাইট খাওয়ার পানি বা পুকুরের পানি পরিশোধন কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত পণ্যের মধ্যে আরও আছে জেম স্টোনও (রত্নপাথর)। এ রত্নপাথর বিভিন্ন কঠিন শিলা বা পাথর ও মিনারেল থেকে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলো সাধারণত অলংকারশিল্পে এবং শোপিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ছাড়া খনিজ ও বালু থেকে মূল্যবান মিনারেল পৃথক্করণ ও বিভিন্ন ধরনের সংকর ধাতু তৈরির কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কাঁচা বালু থেকে রং, রড, সিরামিক তৈরির কাঁচামাল উদ্ভাবন করা হয়েছে।
আইএমএমএমের বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, তাঁদের কাজ শুধু গবেষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণা করতেও সহায়তা করেন। ক্ষেত্রবিশেষে ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের লক্ষ্যে প্রতিবছর এখানে তিন দিনব্যাপী বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে।
আইএমএমএম প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার বিশ্বাস বলেন, তাঁদের গবেষণাগারে ২০০–এর বেশি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ করা হলে গবেষণা কার্যক্রমের পরিধি আরও বাড়বে এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তা অবদান রাখবে।
আইএমএমএম পরিচালক নাজিম জামান বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের রূপকল্প হলো, ‘দেশের খনিজ সম্পদকে নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে শিল্পায়নে ব্যবহার’। এ লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। গবেষণাগার থেকে পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে খনির উন্নয়ন করতে পারবে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি মাইনিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সঠিক পদ্ধতিতে মাইনিং কার্যক্রম পরিচালনা করে সঠিক রয়্যালটিও (সম্মানীও) পাবে।
Collected From Prothomalo