একটি দেশের প্রাণশক্তি হলো তরুণ জনগোষ্ঠী। যেকোনো দেশের মোট জনসংখ্যার যত বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী থাকে, সে দেশ তত বেশি সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পায়। তারুণ্যের শক্তি বা কর্মদক্ষতার ওপর ভর করে একটি দেশ উন্নতি লাভ করে। স্বপ্ন দেখাই হলো তারুণ্যের ধর্ম। তবে তরুণরা মাঝে মাঝে হতাশও হয়!
দুঃখের বিষয় হলো, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে দেশের অধিকাংশ তরুণের মধ্যে কয়েক বছর ধরে মর্মপীড়া কাজ করছে। তরুণ জনগোষ্ঠী দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর ধরে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে যৌক্তিক আন্দোলন করে আসছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার জনমত জরিপেও প্রায় ৯০ ভাগের বেশি তরুণ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে (উল্লেখ্য, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বর্তমানে ১৮-৩০ বছর)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ফেসবুকে’ তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ লাখের বেশি সদস্য রয়েছে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ’ (চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিতে গড়ে ওঠা গ্রুপ) নামক গ্রুপে। তারা বিভিন্ন সময় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে বিগত দিনে সরব থেকেছে এবং এখনো তারা তাদের দাবির বিভিন্ন যৌক্তিকতা তুলে ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে চলেছে।
বলতে দ্বিধা নেই, লাখ লাখ তরুণ সত্যিই আজ হতাশাগ্রস্ত! তারা এ কথা মানতে পারছে না, শুধু পড়তে পড়তে বয়স ৩০ বছর পার হওয়ার কারণে তারা আর চাকরিতে আবেদন করতে পারবে না। বর্তমান রাষ্ট্রপতি তৎকালীন স্পিকার থাকাকালে (২০১২ সালে) জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বর্তমান তরুণসমাজ সময়ের ও প্রাণের এই যৌক্তিক দাবির বিষয়ে এখনো শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে চলেছে। এক-একটা বিসিএসের আবেদনসহ অন্যান্য চাকরির আবেদন চলে যাচ্ছে আর লাখ লাখ তরুণ চোখের জল ফেলছে, তারা আরো হতাশ হয়ে পড়ছে। সদ্য চাকরির বয়স পার হওয়া তরুণদের প্রাণ গুমরে গুমরে কাঁদছে। তারুণ্যের শক্তি আজ ‘৩০’-এর দেয়ালে চাপা পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে! জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে বহুবার দাবিও উঠেছে।
সম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ কথাও বলেছিল, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ছে (সেটা ৩২ বা ৩৩ কিংবা ৩৫ যাই হোক না কেন)। এতে করে তরুণসমাজ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল! তারপর গোচরে-অগোচরে অনেক কথা শোনা গেলেও বাস্তবে কী হচ্ছে কিংবা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আদৌ বাড়বে কি না—তা নিয়ে তরুণসমাজ উদ্বিগ্ন। ৪০তম বিসিএসের চলতি আবেদন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে তরুণসমাজ তাদের শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সরকারের সদয় দৃষ্টির অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
সত্যি বলতে, মানসম্মত চাকরি (১ম-২য় শ্রেণি) পেতে হলে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে করতে প্রায় ২৫ বছর লেগে যায়। গড় আয়ু ৫০ বছর ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ করা হয়। তখন অবসরের বয়সসীমা ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর। আবার অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। গত ২৬ বছরে (১৯৯১ সালের পর) চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা কয়েক দফা বাড়ানো হলেও দুঃখের বিষয় প্রবেশের বয়সসীমা আর বাড়েনি।
পৃথিবীর ১৬০টিরও অধিক দেশে (রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, ভারতসহ অধিকাংশ উন্নত দেশে) চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর অধিক। পাশের ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৪০, রাশিয়াতে অবসরের আগের দিনও সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা যায়। আফ্রিকায় কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫৯ বছরের আগের যেকোনো সময় চাকরিতে প্রবেশ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের একাডেমিক লেখাপড়া শেষ করতে সেশনজট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রভৃতি কারণে প্রায় ২৫ বছর লেগে যাচ্ছে! একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করতে করতে এবং চাকরির পড়াশোনা শুরু করতে করতে বয়স ৩০ পার হয়ে যাচ্ছে। তবে কেন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এ থমকে থাকবে? লাখ লাখ তরুণ চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। বাস্তবতা হলো, বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে কিন্তু চাকরি নেই! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! সহজ কথায়, একজন তরুণকে ৩০-এর গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা হচ্ছে! ফলে বয়স ৩০-এর মধ্যে চাকরি না পাওয়া একজন তরুণকে নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে মধ্যম আয়ের ও উন্নত দেশের পথে এগিয়ে যেতে হলে সব তরুণের মেধা কাজে লাগানো সবচেয়ে বেশি জরুরি! তাই সময়ের দাবি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করা হোক। তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। তাদের অর্ধেক অংশই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করা চাকরিপ্র্রত্যাশী। তবে প্রকৃতপক্ষে বেকারের সংখ্যা আরো বেশি। সরকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে; ভর্তুকি দিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের দেশ গড়ার কাজে সুসন্তান হিসেবে তৈরি করছে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এ বেঁধে রাখার ফলে সরকার এসব শিক্ষার্থীদের মেধা কি আদৌ কাজে লাগাতে পারছে? সরকারি নিয়ম অনুসরণ করার ফলে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে জনবল নিয়োগ দিচ্ছে না! আবার ‘যুবনীতি-২০১৭’-তে যুবাদের বয়স ১৮-৩৫ রাখা হয়েছে। তাহলে কেন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ রাখা হবে?
দেশের সব তরুণের সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। তাই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত তরুণদের কাজে লাগাতে দেশের উন্নয়নে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো প্রয়োজন। এতে করে বেকারত্বের বোঝা কমবে। অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে বেকারদের দ্রুত কর্মসংস্থানে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। সদ্য বেকার বনে যাওয়া তরুণরা দেশের অভিশাপ নয়, তারাও সুযোগ পেলে দেশের ও পরিবারের জন্য কিছু করতে চায়। সেই সুযোগ রাষ্ট্রকে তৈরি করে দিতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের জনশক্তি অপচয় হবে। বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেকে সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন! অনেক মেধা আবার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা ২ বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে! এ ছাড়া অন্যান্য কিছু পেশায় কর্মকর্তাদের অবসরের বয়স আরো বেড়েছে অথচ নিচের দিকে প্রবেশের বয়স বাড়েনি। ফলে ভারসাম্য না রাখার ফলে শুধু বেকারত্ব বেড়েছে, বেড়েছে তরুণদের হতাশা। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো মানে তো চাকরি দেওয়া নয়, বরং একটি সম্ভাবনাময় শেষ হওয়া জীবনগাড়ির চাকা নতুন করে সচল করা। এতে বাড়তি টাকার অপচয়ও হবে না। যে যার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবে। তা ছাড়া একটু বেশি বয়সে চাকরিতে প্রবেশ করলে জ্ঞানের চর্চাও অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে বেকার তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালু আছে। কিন্তু আমাদের দেশে বেকার ভাতা না হোক, অন্তত চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে তরুণদের বেকারত্বের হাত থেকে তো মুক্তি দেওয়া যেতে পারে!
সময়ের যুক্তিসংগত ও যুগোপযোগী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সব দিক বিবেচনা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার সুপারিশ করেছে (একাধিকবার) জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয় ‘সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে তরুণসমাজের আকুল আবেদন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করা হোক। এতে করে চাকরিপ্রত্যাশীরা হয়তো নিজেকে তৈরির এবং মেধা কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে। লাখ লাখ তরুণ তাদের হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনাকে আবার ফিরে পাবে। দেশের প্রত্যেকটি মেধা কাজে লাগবে। দেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
Collected from protidinersangbad