সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিষয়—আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বা সংক্ষেপে আইআর)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। অনেক শিক্ষার্থীই আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়তে চান। এই বিভাগের সুযোগ, সম্ভাবনা কিংবা চ্যালেঞ্জগুলো আদতে কী? আমরা জানতে চেয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, গবেষক ও পেশাজীবীদের কাছ থেকে।
১. কেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়ব?
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনের মতে, ‘পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, বিভিন্ন দেশের মধ্যকার সম্পর্ক, সমাজনীতিসহ নানা বিষয়ে যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়তে পারেন। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন সংস্থায় কাজের সুযোগ তো আছেই। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতকদের সুযোগ বেড়েছে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যারা নতুন জ্ঞান আহরণ করতে চায়, বিশ্বের নানা বিষয় বুঝতে চায়, এই বিষয় তাদের জন্য। বিশ্বরাজনীতির বিভিন্ন বিষয়কে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় এ বিষয়ে পড়ে।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক তাসমিয়া পারসূবের মতে, ‘দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশকে কীভাবে বৈশ্বিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মঞ্চে উপস্থাপন করতে পারি, তা নিয়ে কাজ ও গবেষণার সুযোগ আছে। একদিকে পররাষ্ট্রনীতি, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, শরণার্থীদের বিসয়াশয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা আরও গভীরে পড়ালেখা করতে পারেন।’
২. এই বিষয়ে কী কী পড়ানো হয়?
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে দেখা যায়, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভূমিকা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভূমিকা, বিশ্ববিষয়ক বিভিন্ন মতাদর্শ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা, অর্থনীতির ভূমিকা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি, রাজনৈতিক ভূগোল, মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ বিদেশি ভাষা নিয়ে পড়েন। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে গবেষণার কৌশল শেখার সুযোগ পান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন মো. জান্নাতুল হাবিব। এখন নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যেমন রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় পড়েছি, তেমনি নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, যুদ্ধবিগ্রহ, এসব নিয়েও পড়তে হয়েছে। অর্থনীতি থেকে শুরু করে পরিসংখ্যান, কূটনীতি থেকে উন্নয়ন অধ্যয়ন—সবই পাঠ্য ছিল। শিক্ষার্থীরা “এভরিথিং অব সামথিং” হিসেবে সব ক্ষেত্রের কিছু না কিছু মৌলিক বিষয় জানতে পারেন। এ বিষয়ে পড়তে গিয়েই নানা রকম জটিল পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া শিখেছি।’
৩. দেশের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যায়?
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার সুযোগ আছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
৪. ক্যারিয়ার কোথায়?
সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন জানান, তাঁর শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই বিসিএস দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। অনেকে দূতাবাসে কর্মরত আছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা থেকে শুরু করে দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কাজ করেন কেউ কেউ। এ ছাড়া গবেষণার সুযোগ তো আছেই। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক নাফিসা নাজীন বলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি, সমুদ্রনীতি, রোহিঙ্গা সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করছে।’
৫. উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেমন?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়ে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে রাজনীতি-সমাজনীতির বিভিন্ন বিষয়েও আলাদা করে উচ্চশিক্ষা নেন অনেকে। অভিবাসন, রাষ্ট্রনীতি, পাবলিক পলিসিসহ নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীরা দেশে বা বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। উন্নয়ন অধ্যয়ন বা জেন্ডার স্টাডিজে মাস্টার্স করে পিএইচডি করছেন কেউ কেউ। পশ্চিমা দুনিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণানির্ভর বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্নাতকদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট বৃত্তি, যুক্তরাজ্যের চিভেনিং বৃত্তিসহ বিভিন্ন সুযোগও নিতে পারেন।
৬. কাদের পড়া উচিত?
যাঁরা সমস্যা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন, দেশ-বিদেশের রাজনীতি যাঁদের ভাবায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তাঁদের জন্যই। ইলিয়াছ দিপু কানাডার মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউ ফাউনল্যান্ড থেকে এনভায়রনমেন্টাল পলিসি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব সরলভাবে কূটনীতির নানা বিষয়সহ পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে তৈরি হয়, তা পড়েছি। জলবায়ু কীভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলে, তা জানতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছি। ভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স করলেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়ার কারণে আমি নানা তাত্ত্বিক কাঠামো সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি। বর্তমানে ফিলিপাইনের এটেনিও দ্য ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস লিডারশিপের ওপর পিএইচডি করছেন মায়িশা তাসনীম। তিনি বলেন, ‘আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। চীনা সমরবিদ সানজুর দ্য আর্ট অব ওয়ার বইটির তত্ত্ব স্নাতকে পড়েছি। সেই বইয়ের নানা বিষয় এখন ব্যবসার দুনিয়াতেও দেখতে পাই। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়ার কারণেই ব্যবসার মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারি।’
৭. কাদের পড়া উচিত না?
একদিকে যেমন ইতিহাসের নানান বিষয়কে জানতে হয়, তেমনি এ বিষয়ে পড়ার সময় আধুনিক বা সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে হয়। ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভয়েসেস অব বাংলাদেশ কর্মসূচির সমন্বয়ক আইরিন খান। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন তিনি। বললেন, ‘অনেক শিক্ষার্থী বা গবেষক আছেন, যাঁরা একটি নির্ধারিত বিষয়ের গভীরে যেতে চান। অনেক কিছু পড়তে চান না। তাঁরা সংকটে পড়তে পারেন। আবার অনেক শিক্ষার্থী একটি ভাবনাই আঁকড়ে ধরে থাকতে চান, পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে চান না। এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দিক পরিবর্তন হয়, নতুন তত্ত্ব পুরোনো তত্ত্বকে প্রশ্ন করে, নতুন ধারণা জন্ম দেয়।’ যাঁরা শুধু চাকরিতে আগ্রহী বা ভবিষ্যতে শুধু লাভ-লোকসাননির্ভর ব্যবসা করতে চান, তাঁদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক খুব আকর্ষণীয় না-ও হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
৮. আইআর সম্পর্কে কোন ধারণাটা ভুল?
এ বিষয়ে যাঁরা পড়েন, তাঁরাই কূটনীতিক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়েন, এমন ধারণা অনেকের মধ্যে আছে। আদতে তা নয়। অন্য বিষয়ে পড়েও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ে জানার মাধ্যমে কূটনীতি বা পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্ত হওয়া যায়।
৯. আইআরে পড়ার প্রাথমিক যোগ্যতা কী?
স্নাতকে বিজ্ঞান, ব্যবসায়ে শিক্ষা থেকে শুরু করে মানবিকের শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পেশাদার মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়া যায়। বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানবিষয়ক নানা প্রশ্ন থাকে ভর্তি পরীক্ষায়।
১০. ভবিষ্যৎ কেমন?
করোনাপরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ, নিত্যনতুন ক্যারিয়ার ভাবনা কিংবা প্রযুক্তির কল্যাণে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিষয়ের মতো এ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সামনেও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন আলীমুল হাসান। বর্তমানে জাইকাতে প্রোগ্রাম কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘প্রোগ্রামিং, কোডিংয়ের মতো বিষয় টুকটাক জানা থাকলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় পড়তে হবে না। এই বিষয়ে পড়ার সময় শিক্ষার্থীরা বাংলা-ইংরেজির বাইরে আরও ভাষার শেখার সুযোগ পান। সুযোগটাও কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি নিজেকে হালনাগাদ রাখতে হবে সব সময়।’
Collected from prothomalo