Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
ডিগ্রি পাস কোর্সের ‘গোড়ায় গলদ’, সেশন জটেও বাড়ছে হতাশা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ১৮০০ কলেজে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থী ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি আছেন।
শেরপুরের একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইয়াকুব আলী উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে কাজ নিয়েছিলেন একটি পোশাক কারখানায়। পাশাপাশি ভর্তি হয়েছিলেন ডিগ্রি পাস ও সার্টিফিকেট কোর্সে।

লেখাপড়া চালিয়ে যেতে কিছুদিন আগে চাকরি ছেড়ে দিলেও ভর্তির প্রায় পৌনে চার বছর পর ২০২৩ সালে এসেও তিনি আছেন দ্বিতীয় বর্ষে। তিন বছরের পাস কোর্স এত দিনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা না হওয়ায় হতাশা ভর করেছে তার মনে।

হতাশ ইয়াকুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাবছিলাম পড়ালেখা শেষ করে চাকরি-বাকরি করব, কিন্তু পড়ালেখাই তো শেষ হচ্ছে না। এই পড়া আর না পড়া সমান। না পারছি ছাড়তে, না পারছি ধরতে।”

উচ্চশিক্ষার ধাপ স্নাতক বা ডিগ্রি পাস কোর্স ঘিরে ইয়াকুবের মতো হতাশ হাজারো শিক্ষার্থী।

এমনিতেই স্নাতক কোর্সের বদলে অপেক্ষাকৃত অবহেলিত এ শিক্ষা কার্যক্রমে ভর্তি হয়ে তারা পিছিয়ে। স্নাতকের চেয়ে গুরুত্ব কম পাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দেশজুড়ে ডিগ্রি কলেজগুলোতে ঠিকঠাক ক্লাস না হওয়া, শিক্ষক ও পরীক্ষাগার স্বল্পতায় কোর্সের পাঠদানও হয় ব্যাহত। এরসঙ্গে সময়মত পরীক্ষা না হওয়ায় দীর্ঘদিন একই বর্ষে থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষক এমন প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষায় এ ডিগ্রির কার্যকারিতা ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন।

মূলত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এ পাস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৮০০ কলেজে ডিগ্রি কোর্সে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।

তিন বছর মেয়াদী হওয়ায় দ্রুত পাস করে সনদ পেয়ে কর্মক্ষেত্রে ঢোকার আশায় অনেকেই এই স্তরকে বেছে নেন বলে জানাচ্ছেন ডিগ্রির শিক্ষার্থী ও কলেজগুলোর শিক্ষকরা।

কিন্তু দেরিতে ভর্তি, বিলম্বিত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম, পরীক্ষা বাতিলের কারণে ‘সেশন জট’ নামের পাঁকে আটকে থাকছেন শিক্ষার্থীরা।

যদিও কোর্স শেষ করতে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি মানতে নারাজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান। তিনি অবশ্য একবছর সেশন জট থাকার কথা স্বীকার করেছেন।


গোড়ায় গলদ-ভর্তিতে দেরি

ডিগ্রি পাস কোর্সের নির্ধারিত শিক্ষাবর্ষে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভর্তি শুরুই হচ্ছে প্রায় বছরখানেক পিছিয়ে- এটিই শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামানের ভাষ্য, শিক্ষাবর্ষ শুরু করতেই ডিগ্রির শিক্ষার্থীদের লেগে যাচ্ছে এক থেকে দেড় বছর।

ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষের দিকে তাকালে এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা মিলবে।

বর্তমানে তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রি কোর্সের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাদের কোর্স শেষ করার কথা ২০২১ সালে। এ হিসাবে তারা পিছিয়ে দুই বছর। দুই বছর পিছিয়ে আছেন ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও। তারা এখনও দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় বসতেই পারেননি।

২০২০-২১ সালের শিক্ষার্থীরা ২০২৩ সালে এসে প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল পেয়েছেন। আর ২০২১-২২ এর শিক্ষার্থীরা অপেক্ষায় আছেন প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় বসার।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বদরুজ্জামান বলেন, “২০২২-২৩ সেশনের কথাই ধরুন, এখন ২০২৩ সালের জুন মাস। ২০২২ এর জুলাইতে ভর্তি হয়ে এ সেশনের শিক্ষার্থীরা এতদিনে তাদের প্রথম বর্ষ শেষ করে ফেলার কথা। কিন্তু এই সেশনে শিক্ষার্থীরা এখনও ভর্তিই হয়নি, এক বছর শেষ কিন্তু। তাহলে তারা তো ভর্তিতেই এক বছরের মতো পিছিয়ে থাকছে।”

দেরিতে ভর্তির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রোগ্রামে অনার্স ভর্তি হওয়ার পরেই ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি শুরু হয়। আমরা এখন আমাদের স্নাতক প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির কাজ করব। এরপর ডিগ্রিতে ভর্তি শুরু হবে। এদের আরও অন্তত ছয় মাস লেগে যাবে ভর্তি হতেই।”


সবচেয়ে পিছিয়ে ২০১৯-২০ সেশন

শিক্ষার্থী ইয়াকুব আলী শেরপুর সরকারি কলেজের ডিগ্রি পাস কোর্সে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভর্তি হন। সেই বছরের ডিসেম্বরে শুরু হয় ক্লাস। এরপর কোভিড মহামারীর কারণে ২০২০ সালে ক্লাস হয় শুধু জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে। ২০২১ সালের শেষে এসে বসতে পারেন প্রথম বর্ষের পরীক্ষায়। প্রথম বর্ষ শেষ হতে হতেই ২০২২ সাল।

এরপর এ বছরের ১৫ মে থেকে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল, হয়েছিল সূচিও । তবে ২ মে সেই সূচি স্থগিত করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

হতাশ ইয়াকুব বলেন, “পরীক্ষার জন্য গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিলাম। কোর্স তিন বছরের, এখন চার বছর চলে। এখনও সেকেন্ড ইয়ার পার করতে পারলাম না। শেষ করে ভালো চাকরি করে পরিবারের হাল ধরব ভাবছিলাম। এখন কবে পড়া শেষ করব, কবে চাকরি পাব, কবে কী গোছাব?”

২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে পিছিয়ে এ তথ্য মানছেন শেরপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রশীদ।

তিনি বলেন, “আমরা তো এখান থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিই। কিন্তু তাদের পরীক্ষা, ফরম ফিলাপ এসব বিষয় কখন হবে তা ঘোষণা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এটা একটা পাবলিক পরীক্ষা, কোনো কলেজ চাইলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের তারিখ ঘোষণা ছাড়া পরীক্ষা নিতে পারবে না।”

 কোভিডের কারণেই শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোভিড একটা ফ্যাক্টর। তবে তাই যদি মূল কারণ হত তবে তার প্রভাব তো স্নাতক কোর্সের শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ত।"

পটুয়াখালীর দুমকির মো. আল ইমরানও একই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে আটকে আছেন দ্বিতীয় বর্ষে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আর্থিক দিক খারাপ বলে খুব দ্রুত পাস করে কিছু একটা করা যাবে ভেবেই ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছিলাম। এখন যে অবস্থা, বাড়ির হাল কবে ধরব জানি না। আমরা চাই পরীক্ষাটা সময়মত হোক।”

তবে শিক্ষার্থীদের চার বছরে দ্বিতীয় বর্ষে থাকার কথা মানতে নারাজ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান।

তার দাবি, “পরীক্ষা না হওয়ায় তারা আরও দুই বছর পেছনে আছে এমনটা ঠিক না। তারা সেশন ধরে হিসাব করে বলে যে ’১৯ এ ভর্তি হয়েছে কিন্তু সেটা ঠিক না। দেড় বছর তাদের ভর্তিতেই লেগে যায়। পরীক্ষায় কিন্তু তাদের দেরি হচ্ছে না। এবার যেটা হয়েছে সেটা আলাদা কেইস।”

তিনি বলেন, “বিজিপ্রেস থেকে আমরা যথাসময়ে প্রশ্ন ছাপিয়ে আনতে না পারায় এবার পরীক্ষার রুটিন দিয়েও স্থগিত করতে হয়েছে। বাজেট ছাপার কাজ ছিল, উচ্চ মাধ্যমিকের কাজ ছিল। ফলে বিজিপ্রেস আমাদের স্লট দিতে পারেনি।”


উপাচার্য যা বলেন

তিন বছরের কোর্সে চার বছরেও শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বর্ষ পেরোতে পারেননি-এমন তথ্য নাকচ করে দিয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান।


“চার বছর ধরে শিক্ষার্থীরা আটকে আছে- এ হিসাব বোধহয় ঠিক নয়। সেশন ২০১৯-২০ হলেও তারা ক্লাস শুরু করেছে পরে। এর মধ্যে আবার কোভিড ছিল। আমার জানা মতে আমাদের কোনো ব্যাচে এক বছরের বেশি জট নেই।”

পরীক্ষার সূচি বাতিল প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, “প্রশ্নপত্র ছাপাজনিত একটি দীর্ঘসূত্রতার জন্য ওই রুটিনে পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। অনেক পাবলিক পরীক্ষা থাকায় আমরা প্রেসে প্রশ্ন ছাপানোর স্লট ফাঁকা পাইনি।”

পরীক্ষা সময়মত নেওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেশনজট যতটুকু বলা হচ্ছে তা নয়। কোনো ব্যাচে এক বছরের বেশি জট নেই। কোভিডের আগে আমরা সেশনজট শূন্যে নামিয়ে এনেছিলাম। কোভিডের জন্য এটা একটু বেড়েছে। আমরা যথাযথভাবে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছি যেন এটা একেবারে না থাকে। যথাসময়েই আমরা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য কাজ করছি।”


গুরুত্ব কতটুকু ডিগ্রি কোর্সের?

নেত্রকোণার একটি সরকারি কলেজে বিএ পাস কোর্সে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম (ছদ্মনাম) জানান, উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ঢাকার এক প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি ভর্তি হন ডিগ্রি পাস কোর্সে। তবে ক্লাস তেমন করেননি। শুধু দুবার বর্ষ শেষের ফাইনাল পরীক্ষায় বসেছেন।

শেরপুরের শিক্ষার্থী ইয়াকুব বলেন, “ক্লাস তেমন হয় না বললেই চলে। কারণ স্টুডেন্টই তো যায় না। সপ্তাহে তিন চারদিন ক্লাস হয়। ভর্তি আছে ৫০০ এর উপরে। কিন্তু ক্লাসে গেলে ২০-৩০ জন পাবেন। মূলত ডিগ্রিতে ভর্তি থাকার কারণ হচ্ছে একটা সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে।”

এ পরিস্থিতিতে ডিগ্রি পাস কোর্সের গুরুত্ব কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন রাখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমানের কাছে।

তিনি বলেন, “এই যে আমরা এই ডিগ্রি দিচ্ছি, সেটা কেন দিচ্ছি? এটা ডিপ্লোমা হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু এখানে আমরা গ্র্যাজুয়েট বানাচ্ছি। এই গ্র্যাজুয়েট আমাদের জ্ঞানকাঠামোতে কী অবদান রাখবে? গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা, এখন আবার গ্রামে-গঞ্জেও স্নাতক খোলা হচ্ছে। সেখানে শিক্ষক, অবকাঠামো নেই, গবেষণা নেই। এসব ছাড়া একটা ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার কোনো মানে নেই।

“এই ডিগ্রি কোর্স- এটা না হছে একটা দক্ষতাভিত্তিক ডিপ্লোমা, না হচ্ছে স্নাতকের মতো একটা বিশেষ জ্ঞান। এটা কোনোকিছুই হচ্ছে না। এর টার্গেট কী, কেন এই গ্র্যাজুয়েট বানাচ্ছি তা নিয়ে আমরা পলিসি ঠিক করি না। এই ডিগ্রির কোনো কার্যকারিতা নেই।”

তার মতে, উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি সবার দরকার নেই। এর চেয়ে কারিগরি শিক্ষা দিয়ে তাদের মাঠপর্যায়ে দক্ষতা নিয়ে কাজের জন্য তৈরি করলে বরং ভালো হত।

সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

Collected From Banglabd.24