আয়ারল্যান্ডে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার
আয়ারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ারের ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকের বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার। আগের প্রতিবেদনগুলোতে আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অ্যাকাউন্টিং বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যাঁরা প্রতিবেদনগুলো অনুসরণ করেছেন, তাঁরা কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। আজকের এ প্রতিবেদন বিজ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই উপকারী হবে বলে আমি মনে করি।
মানবসভ্যতার অপরিহার্য অংশ বিজ্ঞান। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই বিজ্ঞানের চাহিদা অনেক। অপেক্ষাকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন বলে ভাবা হয়। পাশাপাশি তাঁরা গবেষণা, তথ্য বিশ্লেষণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান উপস্থাপনেও দক্ষ হন। যে কারণে চাকরিদাতারা বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীদের প্রতি আগ্রহী হন। বিজ্ঞানের নিয়মিত বিষয়গুলো ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যনীতি, উদ্যোগের মতো সমষ্টিগত বিষয়গুলো নিয়েও বিজ্ঞানের ছাত্ররা ভালো সমাধান দিতে পারেন।
সাধারণত বিজ্ঞান বলতে আমরা পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যাকেই বুঝি। তবে এর বাইরেও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিশাল এক জগৎ। যেমন ভূতত্ত্ব মানেই পাথর কিংবা শিলা নিয়ে পড়াশোনা নয়, এ বিষয়ের গবেষণায় পৃথিবীর ইতিহাস, জীবনচক্র, প্রাণীর সৃষ্টি ও বিলুপ্তি সম্পর্কে জানা যায়। তেমনি জেনেটিকস বা জিনতত্ত্ব, ফার্মাকোলজি বা ঔষধবিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজি বা জীবাণুবিজ্ঞান, জিয়োলজি বা প্রাণীবিজ্ঞান, অ্যাস্ট্রোলজি বা জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ অনেক শাখা রয়েছে বিজ্ঞানের। প্রতিটি বিভাগের আলাদা কর্মক্ষেত্র রয়েছে মানবজগতে।
আয়ারল্যান্ডের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিজ্ঞানশিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ডাবলিনের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ট্রিনিটি কলেজে বিজ্ঞানশিক্ষার ওপর অনেকগুলো কোর্স রয়েছে। চার বছর মেয়াদি এসব কোর্সের প্রথম দুই বছর বিজ্ঞানের তিন বা চারটি বিষয়ে পড়ানো হয়। শেষের দুই বছর যেকোনো একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ পাঠ দেওয়া হয়। যার ফলে শিক্ষার্থীরা ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ১৬টি বিভাগের মধ্য থেকে শিক্ষার্থীদের যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হয়। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে সমুদ্রবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অনেক অ্যাডভান্সড কোর্সেও ডিগ্রি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিন ও ডাবলিন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে রয়েছে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ। এই দুটি প্রতিষ্ঠানেও চার বছর মেয়াদি কোর্সের প্রথম দুই বছর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গনিতের মতো মৌলিক বিষয়ে পড়ার পর শেষের দুই বছরে কোনো একটি বিষয়ে বিশেষায়িত শিক্ষা নিতে হয়। ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্ক (ইউসিসি) সরাসরি রসায়নবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জিনতত্ত্বসহ অনেকগুলো বিষয়ে ডিগ্রি দেয়।
ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ) কমন এন্ট্রি ও স্পেশালাইজড—উভয় ধরনের ডিগ্রি দিচ্ছে। এসব ডিগ্রিতে বিজ্ঞানের সব বিষয়ে সম্মিলিত পাঠ কিংবা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এ ছাড়া দেশজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। রয়েছে এমন কিছু কোর্স, যেগুলো এখনো বিশ্বজুড়ে প্রচলিত নয়, অথচ মানবসভ্যতার জন্য জরুরি। যেমন ন্যানো টেকনোলজি। এ ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ট্রিনিটি কলেজ। এখানে ন্যানো সায়েন্স, ক্যামেস্ট্রি অব অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালসের মতো বিষয়গুলোতে ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্ক প্লেসমেন্ট বিষয়ে পড়ানো হয় ডাবলিন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে।
মেরিন সায়েন্স বা সমুদ্রবিজ্ঞানে উন্নতমানের ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে দেশটিতে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি গ্যালওয়ের রায়ান ইনস্টিটিউট এ ক্ষেত্রে ক্রমে নিজের সুনাম বৃদ্ধি করছে। সমুদ্রবিজ্ঞান ও পরিবেশবিজ্ঞানের ওপর আলাদা কোর্স রয়েছে এখানে। এ ইউনিভার্সিটিতে আর্থ অ্যান্ড ওশান সায়েন্সের ওপরও বিএসসি কোর্স রয়েছে।
জেনেটিকসে ডিগ্রি দিচ্ছে ট্রিনিটি কলেজ, ইউসিসি, ডিসিইউ। যে বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীরা সরকারি বেসরকারি ল্যাবে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে, হাসপাতালে, রোগনির্ণয়কেন্দ্র এবং ক্লিনিক্যাল সায়েন্স ও জেনেটিক কাউন্সিলিংয়ে কাজ করার সুযোগ পান।
এর বাইরেও আয়ারল্যান্ডে বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীরা দেশে ও দেশের বাইরে ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আইরিশ হায়ার এডুকেশন অথরিটির ২০১২ সালের এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৬৩ শতাংশ দেশে কিংবা দেশের বাইরে কাজ করছেন। ১০ শতাংশ আরও উচ্চশিক্ষা কিংবা পেশাগত প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পান। এ কারণে অন্যান্য বিভাগের চেয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের¯স্নাতকোত্তর করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। দেশটির শিল্প খাতে বিজ্ঞানের ছাত্রদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। গ্যালওয়ের বায়োমেডিকেল সেক্টর, কর্ক ও ডাবলিনের ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি, হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি খুঁজছে বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীদের। এ ছাড়া খাদ্য ও পানীয় শিল্প, বাণিজ্যিক গবেষণা, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ল্যাব রিসার্চের মতো বিভাগগুলোতেও কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীদের সরকারি–বেসরকারি উভয় খাতে চাকরির সুযোগ রয়েছে।