ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে সতর্ক থাকতে হবে
২০১৩ সালে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসাবে যাত্রা শুরু করে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। ২০২১ সালে পুরোপরি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। বদলানো হয় নামও। বর্তমানে ব্যাংকটি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক নামে পরিচিত। গত ৯ বছরে কী অর্জন, ভবিষ্যতের লক্ষ্য কী? এছাড়া ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়েও যুগান্তরের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাবিব হাসনাত। তার মতে, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে সতর্ক থাকতে হবে।
সৈয়দ হাবিব হাসনাত বলেন, প্রতিষ্ঠার ৯ বছরে অনেক সফলতা রয়েছে। বর্তমানে দেশের স্বনামধন্য, অভিজ্ঞ ও চৌকস ব্যাংকারদের সমন্বয়ে সুনামের সঙ্গে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছি। এই পথচলার সবচেয়ে বড় মাইলফলক ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক’ নাম ধারণ করে পরিপূর্ণ ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক তথা সুদমুক্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করা। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহের প্রধান কারণ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম এবং এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই শরিয়াহর ভিত্তিতে অর্থনৈতিক জীবনযাপনে আগ্রহী। মানুষের ইসলামী মূল্যবোধ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দ্রুত প্রসার ঘটছে, যা ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তুলছে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে লভ্যাংশ মুনাফায়, সুদ হিসাবে নয়। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সময়ভিত্তিক নয়, এটি মুনাফাভিত্তিক। দেশের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাহকই মুসলিম এবং ইসলামী ব্যাংকিংয়ের স্বচ্ছতা ও সেবা অমুসলিমদেরও এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আগ্রহী করে তুলছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ২৭.৫৫ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের ব্যাংকিং খাতে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অবদান ছিল ২৮ দশমিক ২১ শতাংশ। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট প্রবাসী আয়ের ৩০.৯৬ শতাংশই আসে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার ৯০০টি ব্যাংক শাখা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় দুই হাজার ইসলামী ব্যাংকিং শাখা। তাছাড়া দেশব্যাপী উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, এটিএম ও সিআরএম-এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা বিস্তৃত রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তায় বর্তমানে দেশের অনেকগুলো প্রচলিত ব্যাংকের আলাদা ইসলামী ব্যাংকিং সেবা রয়েছে। তাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সফলতার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী।
সৈয়দ হাবিব হাসনাত আরও বলেন, ৯ বছরের সফল পথচলায় গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তি একটি বড় অর্জন। এ বছরের ১৬ অক্টোবর থেকে ব্যাংকের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদন শুরু হয়। যা ২০ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। চলতি বছরের ১৫ জুন প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনের অনুমোদন পায় গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ৮২৭তম কমিশন সভায় এই আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়। আইপিওর মাধ্যমে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের ৪২ কোটি ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যু করা হয়।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) বিনিয়োগকারীদের জন্য রেখেছি বিশেষ সুবিধা। প্রবাসীদের প্রাধান্য দিয়ে ২৫ শতাংশ শেয়ার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিনিয়োগ করা হয়। যেখানে বিনিয়োগকারীদের ১০ হাজার টাকা বা এর গুণিতক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আইপিও আবেদন করার সুযোগ ছিল। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তাই বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের আইপিওতে বিনিয়োগ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এতে করে বাজারের স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য বজায় থাকে। পুঁজিবাজার থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছি এবং এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।
তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর করোনা এবং পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মানসম্পন্ন সেবাদানের পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করি। মহামারির সময়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন সেবা প্রদানে নজর প্রদান করি। শক্তিশালী ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা, ২৪ ঘণ্টা সেবাদানকারী কল সেন্টার, শাখা-উপশাখার বিস্তৃতি, ব্যাংকের সভা-সমাবেশ অনলাইনে আয়োজন, নতুন ব্যাংকিং প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করি। এসব উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডে মিতব্যয়িতার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছি তাতে পরিচালন খরচ অনেক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। সামগ্রিক বিচারে এই উদ্যোগগুলো ব্যবসার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। আশা করছি দ্রুত এই বিরূপ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী ফিরে পাব।
তিনি আরও বলেন, আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকিং খাতকে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি বলা হয়। দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার চাকা সচল রাখতে এ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থনীতির এই চাকাকে সচল রাখতে নিরাপদ এবং কল্যাণমুখী খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য।
শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য সুশাসন নিশ্চিত করা খুব জরুরি। দেশের বিদ্যমান বিভিন্ন নীতিমালা ও আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে স্বচ্ছ ও গতিশীল রাখা সম্ভব। সুশাসন নিশ্চিত করতে কর্মী প্রশিক্ষণ, জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও নজরদারি জোরদার করা একান্ত জরুরি। পাশাপাশি ব্যাংকার এবং উদ্যোক্তাদেরও বিনিয়োগঝুঁকির ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ব্যাংকের মূল ব্যবসায় অনেকগুলো ঝুঁকির মধ্যে বিনিয়োগঝুঁকি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এই বিনিয়োগের মাধ্যমেই ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার এবং মুনাফা নিশ্চিত করা সম্ভব।
Collected from jugantor