Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
চার কারণে বিশৃঙ্খল শিক্ষা প্রশাসন

অদক্ষতা, অযোগ্যতা, খামখেয়ালিপনা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষা প্রশাসনে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। এর ফলে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চলমান এইচএসসি বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ভুল প্রশ্নে এক ঘণ্টা পরীক্ষা নেয়ার পর স্থগিত করার মত ঘটনাগুলো সামনে আসার পর শিক্ষা প্রশাসনের খামখেয়ালিপনার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা বোর্ডের ওপর এবং শিক্ষা বোর্ড শিক্ষকদের ওপর দায় চাপিয়ে ‘নিষ্কলঙ্ক’ হতে চাইছে। কার্যত সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগও নিতে পারছে না শিক্ষা প্রশাসন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দপ্তরসহ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে দক্ষ ও যোগ্য জনবল পদায়ন করতে না পারায় শিক্ষা প্রশাসনে বিতর্কিত ও ভুল কাজের কারবার বেড়ে চলছে। তদবিরের মাধ্যমে যারা দায়িত্বপূর্ণ পদে বসেন তারা ওই চেয়ারে বসে কি কি কাজ করতে হয়, কোন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তত্ত্বাবধান করতে হয়, কোথায় কার সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় করতে হয়, আইন ও বিধিবিধানে কি বলা আছে তা না জেনেই অধীনস্থদের আদেশ দানের মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্ব ‘খালাস’ করতে চান।
২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ডা. দীপু মনি। এর এক মাস পরেই এসএসসি এবং তিন মাস পরে এইচএসসি পরীক্ষা হয়। এর পরে করোনার ছোবলে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাপ্রাপ্ত হয়। করোনা যতদিন ছিল ততদিন বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা পর্যালোচনা হয়নি। কিন্তু করোনা পরবর্তীতে শিক্ষা প্রশাসনের কাজ যত বেড়েছে ততই বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে। গত মাসে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় একজন কেন্দ্র সচিব প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। সে সময়ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ ছিল। সেটি কাটতে না কাটতেই চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন। একই সঙ্গে কারিগরি বোর্ডে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
বরাবরের মতো এসবের দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা বোর্ডের ওপর এবং শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের ওপরেই চাপাচ্ছে। তাদের কথা, প্রশ্নপত্র বোর্ডের কারো দেখার সুযোগ নেই। প্রণয়ন ও পরিশোধনের পর তা সিলগালা অবস্থায় চলে যায় বিজি প্রেসে। সেখানে ছাপার পর প্যাকেটজাত হয়ে কেন্দ্রে যায়। পরীক্ষার দিন প্যাকেট খোলা হয়। কোনো ভুল থাকলে আগে তা জানার সুযোগ থাকে না বোর্ড কর্তৃপক্ষের।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষা প্রশাসনে যোগ্য লোকের অভাব নেই। এইচএসসির বিতর্কিত প্রশ্নের ব্যাখা দিয়ে তিনি বলেন, একজন প্রশ্ন করেছেন ও অন্য চারজন সেই প্রশ্ন দেখে দিয়েছেন। তবু বিতর্কিত বিষয় এসেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, একজন না হয় ভুল করলেন, অন্য চারজন কী করলেন? অর্থাৎ এখানে কেউই নিজেদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেননি।
অন্যদিকে, একাধিক প্রশ্নপ্রণেতা ও পরিশোধনকারী শিক্ষক বলেছেন, প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরিশোধন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে বোর্ড সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সম্মানী নেন। তারা বছরে ছয়টি বোনাস নেন। তাহলে প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় কেন তারা নেবেন না? এছাড়া প্রশ্নপ্রণেতা এবং পরিশোধনকারীদের ঠিকমতো ওরিয়েন্টেশন করা হয় কিনা-সে বিষয়েও বোর্ড কিছু বলছে না। তারা প্রশ্ন দেখতে পারেন না বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ভোরের কাগজকে বলেন, আগেও কিছু ভুল হতো। এখন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। সবাই যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এখানে শিক্ষা বোর্ডের কি কোনো ত্রæটি নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশ্ন প্রণেতা, প্রশ্ন পরিশোধনকারী কারা হবেন তা পরীক্ষা ইউনিট ঠিক করে দেয়। তাদের দেয়া তালিকাভুক্ত শিক্ষকরা প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। সেই প্রণীত প্রশ্ন আরো চারজন মিলে পরিশোধন করেন। এই কাজে শিক্ষকরা জড়িত। বোর্ডের কর্মকর্তারা ওইভাবে যুক্ত নন। বোর্ডের কর্মকর্তারা কি তত্ত্বাবধানও করতে পারেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তা করা হয়। তবু অসাবধানতায় কিছু ঘটে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, আগেও এসব পরীক্ষা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। আগের পরীক্ষাগুলোতে এসব ঘটনা না ঘটলেও এখন প্রতিনিয়ত ঘটছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আগে দক্ষ ও যোগ্যদেরকে শিক্ষা বোর্ডে পদায়ন করা হতো। তারা যোগ্য শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরিশোধন করাতেন। ফলে প্রশ্নপত্রে বিতর্কিত কোনো কিছু থাকত না। এখন তদবিরের মাধ্যমে শিক্ষাবোর্ডে পদায়ন হওয়ায় আগের ওই ‘আভিজাত্য’ নেই। এখন ভাবটা হচ্ছে কোনোরকম কাজ শেষ করতে পারলেই হলো।
‘জড়িতদের চিহ্নিত’ করল শিক্ষা বোর্ড : চলতি এইচএসসির বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ‘সা¤প্রদায়িক উসকানির’ প্রশ্ন রাখার ঘটনায় জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাবকমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার বলেন, প্রশ্নটি যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রণয়ন করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, যশোর শিক্ষা বোর্ড অভিযুক্ত শিক্ষকদের শোকজ করবে। এরপর এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করবে। সে অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। কবে নাগাদ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশা করছি এক সপ্তাহের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে বলা হয়েছে, বাংলা প্রথমপত্রের বিতর্কিত প্রশ্নটি করেছেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ঝিনাইদহের মহেশপুরের ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। আর প্রশ্নপত্রটি পরিশোধনের (মডারেশন) দায়িত্বে ছিলেন নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দীন শাওন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।
জানা যায়, এইচএসসির ৯টি শিক্ষা বোর্ডই চার সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করে। কিন্তু কোনো বোর্ডই নিজের প্রশ্নে পরীক্ষা নেয় না। বাকি ৮টি বোর্ডের প্রশ্নপত্র লটারি করে সেখান থেকে চারটি করে সেট নেয় প্রতিটি বোর্ড। এরপর দুই সেট ছাপে আর দুই সেট রেখে দেয়। যে দুই সেট প্রশ্ন ছাপে বিজি প্রেস, তা সরাসরি ট্রেজারিতে নিয়ে রাখা হয়। প্যাকেটে প্রশ্নপত্র রচনাকারী (সেটার) ও পরিশোধনকারীর (মডারেটর) নাম থাকে।
ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি: চলতি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ধর্মীয় সা¤প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। কমিটির সদস্যদের আগামী সাত কর্মদিবসের মাঝে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল এ তথ্য জানিয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব বলেন, বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানীকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম এবং উপকলেজ পরিদর্শক মদন মোহন দাস।
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাধব চন্দ্র রুদ্র বলেন, তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারমতে, প্রশ্ন সেটিং ও প্রশ্ন মডারেটিং- এই কাজগুলো এমনভাবে হয় যে, যিনি প্রশ্ন সেট করে যান তিনি আর ওই প্রশ্ন দেখতে পারেন না। যিনি মডারেট করে যান তিনিও তা পরে দেখতে পারেন না। সেটার এবং মডারেটর ছাড়া কোনো একটা প্রশ্নের একটা অক্ষরও কারো দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরিশোধনকারীদের ওরিয়েন্টেশনে কি কি বলা হয় তা তিনি স্পষ্ট করেননি।
এর আগে গত রবিবার অনুষ্ঠিত ঢাকা বোর্ডের এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্নপত্রে ধর্মীয় অনুভূতি ও সংবেদনশীলতাকে ক্ষুণ্ন করেছে।
সেই প্রশ্নপত্রে ছিল ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।
এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কুরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কুরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’ কেন এমন প্রশ্ন প্রণয়ন করেছিলেন-উত্তরটি জানতে ঝিনাইদহের মহেশপুরের ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তিনি গতকাল যশোর শিক্ষা বোর্ডকে বলেছেন, এমন প্রশ্নে এভাবে প্রতিক্রিয়া হবে তা তিনি বুঝতে পারেননি। এরপর থেকে তিনি মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন।
Collected from bhorerkagoj