শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজে নৈতিকতার সংকট প্রকট
শিক্ষকরা নীতিবিদ্যা পড়ান চাকরির স্বার্থে আর শিক্ষার্থীরা তা পড়েন পরীক্ষায় পাস করতে। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতার কোনো চর্চা নেই। এমনকি পরিবারগুলোও এখন আর নৈতিকতা শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে না। সমাজ ব্যবস্থায়ও অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুস, অন্যায় ও অবিচারের কাছে নৈতিকতা অসহায় হয়ে পড়েছে। গতকাল রাজধানীর একটি কনভেনশন হলে আয়োজিত ‘শিক্ষা এবং নৈতিকতা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা উঠে আসে। রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) এ সেমিনারের আয়োজন করেছিল।
বক্তারা বলেন, রাষ্ট্রে অপসংস্কৃতি প্রবল ও সংস্কৃতি নির্জীব হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ব্যবস্থা—সবখানের মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিকতার সংকট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। উদাহরণ তৈরি করে পরিবার ও সমাজে নৈতিকতা চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম। আয়োজনে শিক্ষা ও নৈতিকতা বিষয়ে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক খুরশীদা বেগম।
সেমিনারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, আমি হয়তো খুব দক্ষ মানুষ হিসেবে তৈরি হলাম, কিন্তু আমার ভেতরে যদি নৈতিকতা বোধ না থাকে তাহলে সেই শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। সঠিক শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা, সহমর্মিতা ও পরমতসহিষ্ণুতা শেখাতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বড়। আবার একইভাবে শিক্ষকদেরও আগের সম্মান ফিরিয় দিতে হবে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, এর বাইরে পরিবার ও সমাজেও নৈতিকতার চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে।
আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে নৈতিক শিক্ষাকে আলাদা কোনো স্থান দেয়া যায়নি বলে মনে করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, আগে ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদ—এমন অনেক মাধ্যমে নৈতিকতা চর্চা শেখার সুযোগ ছিল। এখন গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আর আস্থা নেই। সমাজতন্ত্রের প্রতিও মানুষ আগ্রহ হারিয়েছে। যখন রাষ্ট্রে অপসংস্কৃতি প্রবল এবং সংস্কৃতি নির্জীব, অপসংস্কৃতিকেই যখন রাষ্ট্রে সংস্কৃতি আখ্যা দেয়া হচ্ছে, তখন সে পরিস্থিতিতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে নীতিবিদ্যা ও নীতিশিক্ষাকে স্থান দেয়া কঠিন।
তিনি আরো বলেন, আমাদের জীবনধারায় উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে আমরা যথাসম্ভব গ্রহণ করব। আমাদের কল্যাণে আমরা সেগুলোকে ব্যবহার করব, কিন্তু সেগুলো দ্বারা আমরা পরিচালিত হব না। প্রযুক্তিকে কর্তার আসন দেয়া যাবে না। প্রযুক্তির দাস হয়ে পড়লে মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, নীতিশাস্ত্রের সফল বিকাশ ঘটাতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যদি এর সঙ্গে পরিবার সংযুক্ত থাকে তাহলে বিকাশটি আশানুরূপ হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সমাজ বাস্তবতা পাল্টেছে, পরিবারের ভেতর সুনীতির চর্চা কমেছে। কোনো কোনো পরিবারে সুনীতির জায়গা নিয়ে নিয়েছে দুর্নীতি। তার পরও অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের মূল্যবোধচর্চায় আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘরের বাইরের জগতে নৈতিকতার স্খলন ও অভাব থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নীতিচর্চাকে উৎসাহিত না করলে পরিবারগুলোর উদ্যোগে শুধু একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের দেশে যে পরীক্ষানির্ভর, সনদমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত, তাতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধার পরিচয় পাওয়া যায় না, বিকাশ ঘটা তো দূরের কথা। এ শিক্ষা নৈতিকতার বিকাশে সহায়ক নয়।
লে. জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় অযোগ্য ব্যক্তিকে সম্মানিত করা কিংবা যোগ্য ব্যক্তিকে অসম্মানিত করতে দেখি বা শুনি। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের সামনে আমরা যোগ্য কোনো রোল মডেল তুলে ধরতে পারছি না। এ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু সমাজের দুর্বলতা দেখলে হবে না। এ থেকে উত্তরণে নিজ নিজ জায়গা থেকে আমরা কী করছি সেগুলোও দেখতে হবে। আমরা ক’জন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একসঙ্গে রাতের খাবার খাই? ক’জন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যাই? আমরা অনেকেই নানা কথা বলি, কিন্তু বাস্তবে নিজেরাই তা অনুসরণ করি না। পরিবর্তনটা নিজের জায়গা থেকে, পরিবার থেকে শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশ আর্মি ও আর্মড ফোর্সেস পরিচালিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় নৈতিক শিক্ষা ও চর্চার সংস্কৃতি বেশ ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা—এসব বিষয়কে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। আমাদের প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকালে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুই হয় নীতি-নৈতিকতা আলোচনার মধ্য দিয়ে। যেন আমাদের ছেলেমেয়েদের মনে সেটা গেঁথে যায়।
এর আগে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন রাওয়ার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আলাউদ্দিন মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন রাওয়ার ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। এ সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।
Collected from bonikbarta