দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ১৯৭০ সালে যাত্রা শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। আবাসিক হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বর্তমানে রয়েছে তীব্র সিট সংকট। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভাগ ও শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লেও আবাসিক হল বৃদ্ধি না হওয়া ও ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরেও রাজনীতির দোহাই দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হলে অবস্থানকে এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন সচেতন মহল।
তবে এই সংকট নিরসনে সম্প্রতি অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ১০ তলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক ছয়টি হল। নতুন হলগুলোতে থাকছে বিভিন্ন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। প্রতিটি হলে রয়েছে এক হাজার শিক্ষার্থীর আসনব্যবস্থা। ধারণা করা হচ্ছে, এতে আবার পূর্ণাঙ্গ আবাসিক রূপ ফিরে পাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
নতুন প্রতিটি হলে রয়েছে ছয়টি লিফট। প্রতিবার প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী লিফটে একসঙ্গে চলাচল করতে পারবে। প্রতিটি রুমের সঙ্গে রয়েছে বারান্দা ও করিডোর। হলের মধ্যে বিনোদনের জন্য রয়েছে কমন রুম, পড়াশোনার জন্য উন্নত মানের লাইব্রেরি, হল ছাত্র সংসদ, মসজিদ, দোকান, সেলুন, কাপড় ধোলাইয়ের দোকান ও ক্যানটিন। ডাইনিংয়ে একত্রে খাবার খেতে পারবে প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের নিজস্ব রান্নার জন্য প্রতি তলায় গ্যাসের চুলার ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে পড়তে আশা শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আলাদা রুম। সেখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহারের সুযোগও রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ব্যায়ামের জন্য হলের মধ্যেই রয়েছে জিমনেশিয়ামের ব্যবস্থা। নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা। এ ছাড়া হল থেকেই ইন্টারনেটের ব্রডব্যান্ড লাইন সংযোগের সুবিধা থাকবে এমনটাই জানা যায় প্রকল্পের প্রকৌশলীদের কাছ থেকে।
নতুন হলগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় ক্যাম্পাসে হলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২-এ, যা দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় বেশি। এর মধ্যে ১১টি ছাত্রদের এবং ১১টি ছাত্রীদের।
নবনির্মিত হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম প্রান্তে ছাত্রদের জন্য ২০, ২১, ২২ নম্বর ভবন এবং পূর্বপ্রান্তে ছাত্রীদের জন্য ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর ভবনের নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এ বছরের ২৩ জানুয়ারি ১৮ ও ২১ নম্বর ভবন এবং গত ৩০ মার্চ ১৭ ও ২০ নম্বর ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন শেষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে হলগুলো বুঝিয়ে দিয়েছে প্রকল্প অফিস। ইতোমধ্যে ১৮ ও ২০ নম্বর হলে সিট বরাদ্দ শেষে শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৭ ও ২০ নম্বর হলে শিক্ষার্থীদের সিট বণ্টনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি দুটি হল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দ্রুতই হস্তান্তর করা হবে। সব মিলিয়ে প্রকল্পগুলোর কাজ এখন প্রায় শেষ।
খুলে দেওয়া নতুন দুটি হলে সিট পেয়ে খুশি শিক্ষার্থীরাও। তারা জানান, এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের আবাসন সমস্যার সমাধান হয়েছে। সমাপ্তি ঘটেছে তাদের অনেকেরই গণরুমের জীবন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ নম্বর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহীন বলেন, ‘প্রায় দুই বছর পর্যন্ত গণরুমে ছিলাম। নতুন হলে আসন পাওয়ায় অবশেষে সেই দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি হয়েছে। মনে হচ্ছে অবশেষে আমি আমার প্রাপ্য অধিকারটুকু বুঝে পেলাম। নতুন হলগুলোতে বিদ্যমান উন্নতমানের সুযোগ-সুবিধাগুলো পড়াশোনার জন্য সহায়ক হবে। কিছু সমস্যা রয়েছে, ডাইনিং-ক্যানটিনগুলো এখনও চালু হয়নি। সেগুলো চালু হলে আমরা পূর্ণাঙ্গ সুবিধা ভোগ করবো বলে আশা করছি।’
বাকি হলগুলো কবে নাগাদ চালু হতে পারে, জানতে চাইলে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘স্থানান্তর না হওয়া দুটি হলে লিফটসহ টুকিটাকি কিছু কাজ বাকি রয়েছে। আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট হস্তান্তর করতে পারবো।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, ‘আশা করছি খুব দ্রুতই বাকি হলগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দিতে পারবো। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সিট সংকট ও গণরুম সংস্কৃতি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।’
এ ছাড়া হলগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে লোকবল নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) যাওয়ার চেষ্টা করবো। লোকবল হয়ে গেলে আমাদের হলগুলো দ্রুত খুলে দিতে সুবিধা হবে।’
উল্লেখ্য, একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর একনেকে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এই অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩টি স্থাপনা তৈরি হবে। এর মধ্যে ছয়টি আবাসিক হল ছাড়াও রয়েছে ১০ তলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন, হাউস টিউটরদের বাসভবন, প্রভোস্টদের আবাসিক কমপ্লেক্স, শিক্ষক, কর্মকর্তা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসিক টাওয়ার, গেস্ট হাউস-কাম গ্র্যাজুয়েট রিসার্চার হাউস, জীববিজ্ঞান, সামাজবিজ্ঞান, কলা ও মানবিক অনুষদ, গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের আনুভূমিক সম্প্রসারণ, লেকচার থিয়েটার এবং পরীক্ষার হল নির্মাণ, নতুন লাইব্রেরি ভবন, স্পোর্টস কমপেক্স, সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চের উন্নয়নসহ ছাত্রীদের জন্য খেলার মাঠ।
Collected From Banglatribune