Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাব গঠন বাধ্যতামূলক হচ্ছে

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞান চর্চা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সংস্কৃতি চর্চার ক্লাব গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর শিগগিরই এই কার্যক্রম চালুর নির্দেশনা দেবে। ‘শিখন-শেখানো’ কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ তৈরিসহ দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকবে বিজ্ঞান ক্লাব, নাটকের ক্লাব, সাহিত্য ক্লাব, সংগীত চর্চার ক্লাব ও ডিবেট ক্লাবসহ ডজন খানেক ক্লাব। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এই উদ্যোগের সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন—এই উদ্যোগ আগেই নেওয়া উচিত ছিল। সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীর মেধাবিকাশ, মূল্যবোধ তৈরি, দায়িত্ব-কর্তব্য পালন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে তোলা এবং তাদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলবে তেমনি মূল্যবোধসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে এই ক্লাব। তবে ক্লাবগুলোকে ‘অরাজনৈতিক’ ও ‘এলিট চর্চামুক্ত’ রেখে কার্যক্রম অব্যাহত রাখারও তাগিদ দেন তারা।


এর আগে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এই ধরনের ক্লাব গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ক্লাব গঠন করে চর্চা অব্যাহত রাখার পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ থাকবে। ক্লাব গঠন ও চর্চা অব্যাহত রেখে শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটাতে হবে।


সরকারের এই উদ্যোগের বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। পাঠ্যবইয়ের মধ্য থেকে ছেলেমেয়েরা যা শেখে, তা লেখাপড়ার একটি ছোট অংশ। এর বাইরে ছেলেমেয়েদের জীবন থেকে, বিদ্যালয় থেকে অনেক কিছু শিখতে হয়। দুঃখজনকভাবে লেখাপড়াটা পরীক্ষাকেন্দ্রিক হওয়ায় বাবা-মায়েরা শিক্ষার্থীদের অন্য কিছুই করতে দেন না। পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য গাইড বই মুখস্থ করা, প্রাইভেট পড়া; এসব বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা চলে গেছে। বাচ্চারা মুখস্থ করতে বাধ্য হচ্ছে। জীবনের অন্য সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই উৎসাহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন বৈচিত্র্য আনবে। আনন্দময় জীবন পাবে শিক্ষার্থীরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীকে অনেক কিছু জানতে হয়। যার যে বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে সেই শিক্ষার্থী যদি সে বিষয়ে চর্চা করার সুযোগ পায়, তাহলে সে অনেক কিছু করতে পারবে। এটি যদি কার্যকর হয় তাহলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।'


বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি এই ক্লাব গঠন করতে পারি এবং এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চর্চাসহ বিভিন্ন চর্চা করাতে পারি তাহলে পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও দেশ গঠনের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।’

একসময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও আনন্দদায়ক ছিল। তবে অতি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে দিন দিন তা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে কিছু (এমন কার্যক্রম) ছিল, পরবর্তী সময়ে পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন অবস্থা হয়েছে যে কোচিং আর নোট-গাইডের পাল্লায় পড়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা সহশিক্ষা কার্যক্রম ভুলতে বসেছে। মেধা ও মননের চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যার কারণে। নতুন শিক্ষাক্রমে একটি সুযোগও তৈরি হয়েছে। সরকার এখন যে চিন্তা করছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক। পাঠাগার ও বিজ্ঞানাগার যেমন শিক্ষার জন্য, তেমনি শিক্ষার্থীরা যদি নিজেরা চর্চা করতে পারে তাহলে মেধা ও মননের বিকাশ তৈরি হবে, নেতৃত্ব বিকাশও হবে।’

তবে এসব ক্লাবকে রাজনীতিমুক্ত রাখার প্রতিও তাগিদ দিলেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘আমরা ধরে নিই, যুব সমাজের মধ্যে নেতৃত্বগুণ শুধু রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়েই হয়। আসলে সেটি ঠিক না। রাজনীতি একটি জায়গা, আসলে শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে স্কুলের খেলার মাঠে এবং নানা কর্মসূচিতে অংশ নেয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা যদি গুরুত্ব দেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা একুশ শতকের দক্ষতা নিয়ে বেড়ে উঠবে। এর সঙ্গে মূল্যবোধেরও বিষয় আছে। যাতে এর মধ্যে দলীয় রাজনীতির প্রভাব না থাকে, এটি করতে পারলে ভালো হয়।’

মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যেটা সবসময় দেখেছি, গ্রামগঞ্জে এগুলো যখন গঠিত হয়, তখন সেখানে ‘এলিট চর্চা’ শুরু হয়ে যায়। মূলত এই সংগঠনগুলো এলিটদের দখলে চলে যায়। এটি যদি বৈষম্যহীনভাবে করা যায় তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়, এটি খুবই দরকার।’

রাজধানীর পীর ইয়ামেনি জামে মসজিদের খতিব মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসাতেও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন বক্তৃতা হয়ে থাকে। সাপ্তাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। এর ফলাফল আমরা পাচ্ছি। বিজ্ঞান ক্লাব বিতর্ক-বক্তৃতা প্রশিক্ষণের উদ্যোগে সাধুবাদ জানাই। আমাদের ছাত্ররা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবে, ছাত্ররা যখন একত্রিত হয়, তখন বিভিন্ন বিষয় শেখার থাকে। আমাদের সাহিত্য আড্ডাগুলো থেকে লেখক হয়ে উঠতে পারবে শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজে এই উদ্যোগে একটি ভালো ফলাফল আসবে ইনশাআল্লাহ।’

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘খুব শিগগিরই এই ক্লাব চালু করার নির্দেশনা দেওয়া হবে। স্কুল-কলেজগুলোয় বাধ্যতামূলকভাবে ক্লাব গঠন করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোনও না কেনও ক্লাবের সদস্য থাকতে হবে। ‘

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর সূত্রে আরও জানা গেছে, ডিবেট ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, নাটকের ক্লাব, গানের ক্লাব, সাহিত্য ক্লাবসহ ডজন খানেক ক্লাব গঠন করা হবে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

অধ্যাপক নেহাল আহমেদ আরও বলেন, ‘প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ক্লাব গঠন করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোনও না কোনও একটি ক্লাবের বাধ্যতামূলক সদস্য হতে হবে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চারটি বা পাঁচটি ক্লাব থাকলে ‘গ’ শ্রেণি, ৮টা বা ৯টা ক্লাব থাকলে ‘খ’ শ্রেণি এবং ১০টি বা ১২টি থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেষ্টা থাকবে ‘ক’ শ্রেণিতে যুক্ত হওয়া। এই প্রক্রিয়াগুলো আমরা খুব তাড়াতাড়ি শুরু করবো।’
Collected From Banglatribune